জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেদিন ভোররাতে শেখ কামালকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল বর্বরতা, আর শেষ হয়েছিল শিশু শেখ রাসেলকে হত্যার মধ্য দিয়ে।
এরে আগেই বঙ্গবন্ধু তার আত্মীয় ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে যান। তখন ওপর থেকে বঙ্গবন্ধু নিচতলায় তার ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলামকে টেলিফোন করে বলেন, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। তাড়াতাড়ি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে হবে। কিন্তু পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করেও কোনো সাড়া শব্দ পাননি মহিতুল।
সেই কালরাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় অবস্থান করা তার ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রহমান শেখ রমা এভাবেই বর্ণনা দিয়েছেন ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের। ভোররাতে ধানমন্ডির বাড়িটি আক্রান্ত হওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু যে ঘরে ছিলেন তার বাইরের বারান্দায় ঘুমিয়েছিলেন শেখ রমা।
সেদিন ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগিনীপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার ছেলে আরিফ ও সুকান্তবাবু, মেয়ে বেবি, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।
শেখ রমা ১৯৬৯ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর পরিবারে কাজ করতেন, ’৭১-এ ওই পরিবারের সঙ্গে ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে যে মামলা করা হয় তার দ্বিতীয় সাক্ষী এই রমা।
‘সেদিন ভোররাতে বাড়িটির দিকে দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়। একটু পরেই বঙ্গবন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। বেগম মুজিবের কথায় আমি নিচে নেমে মেইন গেটের বাইরে এসে দেখি সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। তখন আমি বাড়ির ভেতরে ফিরে দেখি, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা অবস্থায়ই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামছেন,’ বলেন রমা।
পরে রমা দ্রুত দোতলায় গিয়ে দেখেন, বেগম মুজিব আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন। রমা সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে তিন তলায় চলে যান এবং শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। তখন দ্রুত শার্ট-প্যান্ট পরে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল। সুলতানা কামাল চলে যান দোতলায়। পরে শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে তুললে তারা দ্রুত জামাকাপড় পরে বেগম মুজিবের কক্ষে যান।
রমা বলেন, গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল ইসলাম। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার একপর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।’
বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করতে পারেননি। একঝাঁক গুলি জানালার কাচ ভেঙে অফিসের দেয়ালে লাগে। বঙ্গবন্ধু তখন টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন। এর মধ্যেই গৃহকর্মী আব্দুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন বেগম মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণ থেমে গেলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুলের হাত থেকে পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে পরেন। নিচতলার এই ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে বঙ্গবন্ধু পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ?’ এ কথা বলেই বঙ্গবন্ধু উপরে চলে যান।
বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় দাঁড়ান। তখন কোনো কথা না বলেই শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা। নিজেকে বাঁচাতে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। বলতে থাকেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালকে লক্ষ্য করে বজলুল হুদা তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান শেখ কামাল।
আব্দুর রহমান রমা বলেন,
নিচে কী হচ্ছে তার কিছুটা আঁচ করতে পেরে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন। একপর্যায়ে ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিনকে পান। তিনি তাকে বলেন, ‘জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকেরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’
পরে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাকে বলেন, ‘সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে (শেখ কামাল) বোধহয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’
এরপর ঘাতকরা গুলি করতে করতে উপরে চলে যায়। তারা শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেয়া গৃহকর্মী আব্দুলকে গুলি করে। হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিনি সিঁড়ির পাশে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে থাকেন।
বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনি ছাড়াও ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলেই ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে।
মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সেনারা বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। এ সময় বঙ্গবন্ধু ঘাতকদের কাছে তারা কী চায় এবং বঙ্গবন্ধুকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা জানতে চান। এ সময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় নূর কিছু একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর তাদের স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে।
রমা জানান,
দোতলায় হত্যাযজ্ঞ শেষে শেখ রাসেল এবং তাকে যখন নিচে নিয়ে আসা হয়। তখন রাসেল বলছিল, ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?’ এ রকম শিশুকে নিশ্চয়ই খুনিরা মারবে না আশায় মহিতুল ইসলাম তাকে জড়িয়ে ধরে বলছিলেন, ‘না, ভাইয়া, তোমাকে মারবে না’। পরে রাসেল বলে, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’
পরে এক হাবিলদার শেখ রাসেলকে তার হাত ধরে দোতলায় নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দোতলায় গুলি এবং সেখান থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ পাওয়া যায়। আর ওই হাবিলদার নিচে গেটের কাছে এসে মেজর আজিজ পাশাকে বলে, ‘স্যার, সব শেষ।’
এর আগে আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী এবং শেখ কামালের স্ত্রীকে হত্যা করে।
সূত্র: বাসস
এ জাতীয় আরো খবর..