জাহিদ খান, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:
দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা কুড়িগ্রাম। কুড়িগ্রাম নদনদী সমৃদ্ধ জেলা।এ জেলার মধ্যে দিয়ে ছোট বড় ৪৪ টি নদ নদী প্রবাহিত তন্মধ্যে ব্রম্মপুত্র,দুধ কুমর,গঙ্গাধর,ধরলা,তিস্তা বৃহৎ নদী। এ জেলার উপজেলা সমূহের এক তৃতীয়াংশ ইউনিয়ন নদী ভাঙ্গনের করাল গ্রাসে বিপর্যস্ত।
এ জেলার সর্বো উত্তরের উপজেলা ভুরুঙ্গামারী। ভুরুঙ্গামারী উপজেলার তিলাই,চর ভুরুঙ্গামারী, বঙ্গ সোনাহাট,
পাইকের ছড়া,বলদিয়া, আন্ধারীঝাড় ইউনিয়ন সমূহের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গাধর ও দুধ কুমার নদীর ভাঙ্গনে জনজীবন বিপর্যস্ত। সাম্প্রতিক বন্যার পর তীব্র স্রোতে নদীর পাড় ভেঙে বহু ঘরবাড়ি, ফসলি জমি এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
একই ভাবে নাগেশ্বরী উপজেলার রায়গঞ্জ,বামন ডাঙ্গা,বেরুবারি,কালিগঞ্জ,নুনখাওয়া,কচাকাটা,নারায়নপুর,বল্লভের খাস,মাদারগঞ্জ ও কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন ঘোগাদহ,যাত্রাপুর,পাচগাছি র বুক চিরেও প্রবাহিত হচ্ছে দুধ কুমর ও গঙ্গাধর নদী।এই নদী দুটির অববাহিকায় অব্যাহত নদী ভাঙনে হতাশা আর দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
ফুলবাড়ি উপজেলার চিত্র ও এর ব্যতিক্রম নয়।ফুলবাড়ি উপজেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ধরলা নদী উপজেলার ফুলবাড়ি সদর,বড়ভিটা ইউনিয়ন সঙ্গে কুড়িগ্রাম সদরের কাঠালবাড়ি,হোলোখানা ইউনিয়ন ও এই নদীর ভাঙ্গনে চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
জেলার রাজার হাট উপজেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে প্রমত্তা তিস্তা নদী।এর অববাহিকায় ঘড়িয়াল ডাঙ্গা,বিদ্যানন্দ,নাজিমখা ইউনিয়ন প্রতিবছর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিতে পতিত হয়।
উলিপুর উপজেলার মধ্যে প্রবেশ করেছে ব্রম্মপুত্র নদ।এই নদ উলিপুরের হাতিয়া,সাহেবের আলগা,বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ভাঙ্গনের মূল কারিগর।
চিলমারী উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত ব্রম্মপুত্র।
এর ভাঙ্গণে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ বাড়িঘর,কৃষি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে থানাহাট,রমনা,অষ্টমীর চর, নয়ার হাট ইউনিয়নের জন সাধারণ।
রৌমারী উপজেলার বন্দবেড়,রৌমারী, দাতভাঙ্গা,শৌলমারি,চর শৌলমারী,যাদুর চর প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় ব্রম্মপুত্রের করাল গ্রাসে।
রাজীব পূর উপজেলার রাজীবপুর,কোদালকাটি,মোহন গঞ্জ ইউনিয়ন কেও আগ্রাসী ব্রম্মপুত্র এক চিলতে ছাড় দেয় না।
নদী ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন সম্পর্কে জানতে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,তারা প্রতি বছর উর্ধতন কতৃপক্ষ কে জেলার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বলতে প্রতিবছর ই বিভিন্ন উপজেলায় বাধ নির্মান,জিও ব্যাগ, ব্লক ফেলেও ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।এতে এক কূল রক্ষা হলে আরেক কূল ভাঙ্গনের মূখে পতিত হয়।তারাও স্বীকার করেন প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ কম থাকায় টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা যাচ্ছে না।
নদী ভাঙ্গনের কারণ ও প্রতিকার বিষয়ে সরকার, বিভিন্ন এন জি ও স্বেচ্ছাসেবক,গবেষক গণের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে যা জানা যায়-
নদী ভাঙনের কারণ ও প্রতিকার:
নদী ভাঙন বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রকৃতিক দুর্যোগ। এর ফলে প্রতিবছর অনেক মানুষ জমি, ঘরবাড়ি, ও জীবিকা হারায়। নদী ভাঙন শুধু ক্ষতির কারণ নয়, বরং এটি দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ এবং সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
নদী ভাঙনের কারণ:
নদী ভাঙনের পেছনে বেশ কিছু প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণ রয়েছে:
১.প্রাকৃতিক কারণ
>নদীর তীব্র স্রোতঃ বর্ষাকালে পানির প্রবাহ বেড়ে গেলে নদীর তীর ভাঙনের ঝুঁকি বাড়ে।
>নদীর স্বাভাবিক গতি পরিবর্তনঃ নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে একপাশের তীর ধ্বংস হয়।
>মাটির গঠনঃ নদীর তীরের মাটি যদি নরম ও দানাদার হয়, তবে তা সহজেই ক্ষয়ে যায়।
>পাহাড়ি ঢলঃ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল নদীর পানির পরিমাণ ও গতি বাড়ায়, যা ভাঙন সৃষ্টি করে।
২.মানবসৃষ্ট কারণ
>নদী খননের অভাবঃ দীর্ঘদিন ধরে নদী খনন না করায় পলি জমে নদীর গভীরতা কমে যায়।
>অবৈধ বালু উত্তোলনঃ নদী থেকে অতিরিক্ত বালু উত্তোলন নদীর তীরকে দুর্বল করে তোলে।
>জলবায়ু পরিবর্তনঃ অতিবৃষ্টি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, এবং অস্বাভাবিক বন্যা নদী ভাঙনের ঝুঁকি বাড়ায়।
>অবকাঠামো নির্মাণঃ অপরিকল্পিত বাঁধ ও সেতু নির্মাণ নদীর গতিপথ ব্যাহত করে এবং তীর ভাঙনের কারণ হয়।
নদী ভাঙনের প্রতিকারঃ
নদী ভাঙন রোধে কিছু কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
১. প্রযুক্তিগত সমাধান
>তীর রক্ষা প্রকল্পঃ বাঁধ নির্মাণ, কংক্রিট ব্লক বসানো, এবং জিও ব্যাগ ব্যবহার করে তীর রক্ষা করা।
>নদী খননঃ নিয়মিতভাবে নদী খননের মাধ্যমে পানির প্রবাহ ও গভীরতা বজায় রাখা।
>জিওটেক্সটাইল ব্যবহারঃ নদীর তীরে জিওটেক্সটাইল বসিয়ে ভাঙন প্রতিরোধ করা।
২. পরিবেশগত সমাধান
>বনায়নঃ নদীর তীরে গাছপালা লাগিয়ে মাটি ধরে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
>প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিঃ পলিমাটি দিয়ে সঠিকভাবে বাঁধ নির্মাণ করে নদীর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করা।
৩. মানবসম্পদ উন্নয়ন
>জনসচেতনতা বৃদ্ধিঃ নদী ভাঙন রোধে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা।
>স্থানান্তর সুবিধাঃ ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্প এবং জরুরি ত্রাণের ব্যবস্থা করা।
৪. দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাঃ
>নদী ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়নঃ বিজ্ঞানসম্মত ও পরিবেশবান্ধব নদী ব্যবস্থাপনা নীতিমালা তৈরি করা।
>আন্তর্জাতিক সহযোগিতাঃ সীমান্তবর্তী নদীগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ।
নদী ভাঙন রোধে প্রযুক্তিগত, পরিবেশগত, ও সামাজিক সমাধানগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকার, স্থানীয় প্রশাসন,স্থানীয় জন প্রতিনিধি এবং জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। একমাত্র সুসংগঠিত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমেই আমরা নদী ভাঙনের মতো ভয়াবহ সমস্যার সমাধান করতে পারি।
এ জাতীয় আরো খবর..