রাজধানীর প্রধান প্রবেশ পথগুলোর মধ্যে অন্যতম যাত্রাবাড়ি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কঠোর প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে গতবছর জুলাইয়ে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে যাত্রাবাড়ি বিক্ষোভকারীদের অন্যতম ঘাঁটিতে পরিণত হয়। সেসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধের মুখে এলাকাটি একটি প্রধান রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। যেখানে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশ করতে হাজার হাজার মানুষ যাত্রাবাড়ি থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত চার কিলোমিটারের রাস্তায় অবস্থান নেয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও শেখ হাসিনার অনুগত বাহিনীর সাথে তুমুল সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
সরকারি চাকরিতে ন্যায্য কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হলে ছাত্রদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন ও অমানুষিক নির্যাতনে দিশেহারা দেশবাসী যাত্রাবাড়ির মতো বিভিন্ন স্থানে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার পতনে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণে ‘যাত্রাবাড়ি প্রতিরোধ’ অসামান্য ভূমিকা পালন করে।
স্থানীয়রা জানায়, যাত্রাবাড়ি ও এর আশেপাশের এলাকা, বিশেষ করে কুতুবখালী, কাজলা, শনির আখড়া, ডেমরা রোড এবং রায়েরবাগ এলাকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ কেন্দ্রে পরিণত হয়। তাদের প্রতিহত করতে ১৭ জুলাই পুলিশ আন্দোলনকারী জনগণের ওপর গুলি চালালে অনেকে নিহত হয়।
একটি বাস কোম্পানির প্রাক্তন টিকিট মাস্টার মো. সফিকুল ইসলাম ছাত্র আন্দোলন কীভাবে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল তার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলনকারীদের উপর সরকারের বর্বরতার প্রতিবাদে আমার মতো সাধারণ মানুষও ১৭ জুলাই থেকে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল’।
তিনি বলেন, গত ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ছাত্র আবু সাঈদকে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে হত্যাসহ সারাদেশে আরো পাঁচজন শিক্ষার্থীকে হত্যার ঘটনা দেশবাসীকে রাস্তায় নামতে অনুপ্রাণিত করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড ও হত্যাকাণ্ডের ভিডিও জাতি গ্রহণ করতে না পারায় অবশেষে ছাত্র আন্দোলন এক বৈপ্লবিক রূপ ধারণ করে। আবু সাঈদ হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক জুলাই আন্দোলনের প্রতীক।
ছাত্র আন্দোলন পরবর্তীতে জনতার আন্দোলনে পরিণত হওয়ার পেছনে অভিভাবকদের যুক্ত হওয়ার যৌক্তিকতা উল্লেখ করে সফিকুল বলেন, ‘পুলিশ যখন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের ওপর গুলি চালায়, যারা শুধু কোটা সংস্কার চেয়েছিল, তখন ন্যূনতম বিবেকসম্পন্ন কোনো অভিভাবকের পক্ষে কি বাড়িতে বসে থাকা সম্ভব?’
১৭ জুলাই থেকে যাত্রাবাড়িতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’-এর মাধ্যমে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিলো স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।
চাকরিজীবী, দিনমজুর, দোকানদার, বাবুর্চি, দর্জি, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, গার্মেন্টস শ্রমিক, ফ্রিল্যান্সার, মাদ্রাসা ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দেন। স্তন্যদানকারী মাও এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী নিশ্চিত করেছেন যে তিনি যাত্রাবাড়ির ধোলাইপাড় এলাকায় ছয় থেকে সাত মাস বয়সী শিশুকে কোলে নিয়ে একজন স্তন্যদানকারী মাকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে রাস্তায় স্লোগান দিতে দেখেছেন ।
স্থানীয়রা জানায়, সরকার যখন ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে এবং সারাদেশে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে গণগ্রেফতার শুরু করে তখনও বিক্ষোভকারীরা এক মুহূর্তের জন্যও যাত্রাবাড়ি এলাকায় রাস্তা ছাড়েনি।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, কারফিউ জারির পরও যাত্রাবাড়ি ও এর আশপাশের এলাকায় টানা পাঁচ দিন ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল।
আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হকার মো. হানিফ বলেন, সরকার যখন কারফিউ জারি করে শহরের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়, তখনও যাত্রাবাড়ি আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
স্থানীয়রা জানান, ১৯ জুলাই রাতে রায়েরবাগ এলাকায় দুই পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালায় এবং র্যাব আকাশ থেকে টিয়ারশেল ও বুলেট নিক্ষেপ করে।
রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ সেপ্টেম্বর শাহাদাত বরণকারী নির্মাণ শ্রমিক বাবলু মৃধা ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।
তার ১৭ বছর বয়সী ছেলে মো. আবু তালিব বলেছেন, তার বাবা হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া বুলেটে আহত হয়েছিলেন এবং একই সময়ে আরও তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যাত্রাবাড়ি শহরের কুতুবখালী এলাকার যাত্রাবাড়ি বড় মাদ্রাসার একজন ছাত্র বলেন, আমরা আমাদের বিবেক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছি।
গত ১৯ জুলাই বুলেটের আঘাতে আহত বাম চোখের দৃষ্টি হারাতে থাকা পিকআপ ভ্যান চালক মো. রিপন বলেন, পুলিশ জনগণের ওপর এমন নির্বিচারে গুলি চালাতে পারে তা আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। কিন্তু এই গোলাগুলিই জনগণের মধ্যে একটি গুরুতর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
হতাহতের সংখ্যা কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না উল্লেখ করে রিপন বলেন, সেখানে যত বেশি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে, তত বেশি মানুষ লড়াইয়ে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত হয়েছে। সেখানে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো যে, মনে হচ্ছিলো এটি একটি যুদ্ধক্ষেত্র এবং কারো বাড়িতে থাকার সময় নেই।
সোনারগাঁও সরকারি কলেজের তৃতীয় বর্ষের (সম্মান) ছাত্র মেরাজ হোসেন পিয়াল-এর কথায় প্রতিবাদী রিপনের কথাই প্রতিধ্বনিত হল। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমি দেখেছি, সন্ধ্যার পর মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বিপুল সংখ্যক মানুষ বিক্ষোভ করছে। তখন মনে হয়েছে আমরা সিনেমা হলে একটি হরর মুভি দেখছি’।
আন্দোলনে ছোট ভাইকে হারানো পিয়াল বলেন, যখন পুলিশ গুলি করছিল তখন লোকেরা উদভ্রান্তের মতো দিকবিদিক দৌড়াচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার তারা রাস্তায় জড়ো হচ্ছিল।
একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসার যখন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে বিক্ষোভকারীদের মোকাবেলায় তাদের কঠোর অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করছিলেন তখন তার কথায় পিয়ালের বক্তব্যের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে আসাদুজ্জামানকে উদ্দেশ্য করে ওই কর্মকর্তাকে বলতে দেখা যায়, ‘আমরা যখন একটি গুলি করি তখন একজন নিহত বা আহত হয়। একজনই যায়। বাকিরা যায় না। এটাই দুশ্চিন্তার।
স্থানীয়দের মতে, রাস্তায় মানুষ হত্যা ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পরিবারকে হয়রানি করেছে যা জনগণকে ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর বিক্ষোভে উদ্বুদ্ধ করে।
পিয়াল বলেন, ১৯ জুলাই তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার পরিবার নির্মম নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। তখন তাদের একটি পুলিশ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার থাকলে আমরা বাঁচতে পারতাম না। তাই আমরা যেকোনো মূল্যে ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনার পতন চেয়েছিলাম’।
আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবারের অনেক সদস্যের পরিণতি পিয়ালের মতোই হয়েছে।
অবশেষে, শুধু যাত্রাবাড়ি এলাকাতেই প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু এবং কয়েক হাজার মানুষের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্যে দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থান সফল হয়।