নিজস্ব প্রতিবেদক: হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেনকে ঋণ খেলাপি ঘোষণা করার দাবি জানানো হয়েছ। শেয়ার মার্কেটের একজন বিনিয়োগকারী শেখ আমিনুল ইসলাম রনি সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক হাইকোর্টের একটি আদেশের উপর স্থগিতাদেশ এবং একজন সিনিয়র আইনজীবী কর্তৃক স্থগিতাদেশ সংক্রান্ত আদেশের সার্টিফিকেট কপি গত ৪ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো কর্তৃক মোয়াজ্জেম হোসেনকে ঋণ খেলাপি হিসাবে তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে বলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, মোয়াজ্জেম ২০০৮ সালে ন্যাশনাল ক্রেডিট এন্ড কমার্স ব্যাংক (এনসিসি) থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করেন। এনসিসি ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো একটি চিঠির সূত্রে জানা যায়, মোয়াজ্জেম এর এনার্জি প্রিমা নামক একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামাল ক্রয় ও অন্যান্য প্রয়োজনে প্রায় ৯০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। গ্রহণের পর বিভিন্ন সময়ে এনসিসি ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধে বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও তিনি তা পরিশোধে ব্যর্থ হন। ফলে এনসিসি ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেয়া চিঠির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) মোয়াজ্জেম হোসেনকে ঋণ খেলাপি হিসাবে তালিকাভুক্ত করে। কিন্তু মোয়াজ্জেম উঁচ্চ আদালতের আশ্রয় নিয়ে সিআইবির এ সিদ্ধান্ত স্থগিত করে। পরে আপিল বিভাগ এ স্থাগিতাদেশ বাতিল করে দেন। কিন্ত মোয়াজ্জেম হোসেন আপিল বিভাগের এ আদেশ গোপন করে গত বছর ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
সূত্র জানায়, গত বছর ন্যাশনাল ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভা উপলক্ষে পরিচালক নির্বাচনের যে প্রক্রিয়া হয় তাতে মরিয়া হয়ে কাজ করছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। কিন্তু অনলাইন ভোটিংয়ের মাধ্যমে শেয়ার হোল্ডাররা মোয়াজ্জেমকে প্রত্যাখ্যান করায় তিনি পরিচালক পদে নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হন।
এরপর থেকেই তিনি মরিয়া হয়ে উঠেন ন্যাশনাল ব্যাংকের নির্বাচিত পর্ষদকে বাতিল করে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠনের জন্য। এই প্রচেষ্টারই অংশ হিসাবে তিনি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নির্বাচিত পরিচালকদের বিরুদ্ধে নানা রকম কুৎসা রটাতে থাকেন। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি চক্রের সাহায্যে সফল হন এবং নির্বাচিত পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে অনির্বাচিতদের মাধ্যমে নতুন পরিচালনা পর্ষদে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করান। অথচ এখন পর্যন্ত এনসিসি ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া ঋণ তিনি পরিশোধ করেন নি। বরং নানা ছলছূতোয় এবং আইনের মারপ্যাচে এই ঋণ পরিশোধকে ঠেকিয়ে রাখছেন।
ন্যাশনাল ব্যাংকের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, মোয়াজ্জেম ইতপূর্বে চারটি কোম্পানির নামে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে ছিলেন। কিন্তু পরবর্তিতে এই ঋণ গুলো সুদসহ রাইট অফ করান, যা ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং বাংলাদেশে ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ রাইট অফ এর ক্ষেত্রে সুদ মওকুফ করা সম্ভব হলেও মূল ঋণ কখনও রাইট অফ হয় না। অথচ রেকর্ড থেকে দেখা যায় যে, চারটি কোম্পানির নামে গ্রহণকৃত ঋণ সুদসহ মওকুফ করা হয়েছে। এ কোম্পানিগুলো হচ্ছে- রোজ এন্ড বিজ, মিশু মটরস, চ্যানেল ইন্টারন্যাশনাল এবং গ্লোব মটরস। এতে দেখা যায়, ঋণ খেলাপি হয়েও হোসাফ গ্রুপের মোয়াজ্জেম হোসেন ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন।
মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে যে, ২০০৭-০৮ সালে এক-এগারোর সরকারের সময় তিনি একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার অনুমোদন পান। কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য যে জেনারেটর আমদানি করা হয় তা দিয়ে কখনো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। ফলে এসব মেশিন আমদানিতে যে বিপুল বৈদেশিক মূদ্রা খরচ হয় তা ছিল সম্পূর্ণ অপচয়। অথচ এলসির মাধ্যমে আমদানি করা এসব অর্থ কখনো ব্যাংক ফেরত পায়নি।
এদিকে জানান যায়, মোয়াজ্জেম বিএনপি ঘরানার একজন ব্যবসায়ী হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে তিনি রাজনৈতিক রং পাল্টে ফেলেন এবং একটি প্রভাবশালী চক্রের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। এরপর একের পর এক বিদ্যুৎ খাতে এবং অন্যান্য সেক্টরে ব্যবসা করতে থাকেন। তিনি এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন নিয়ে তা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর সবগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রেই তিনি বিদ্যুতের দাম অন্যান্য কেন্দ্র থেকে অনেক বেশি নির্ধারণ করে সরকারের কাছে বিক্রি করছেন।
মোয়াজ্জেম এবং তার পরিবার বরাবরই বিএনপি ঘরানার ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তার ভাই মোশাররফ হোসেন ছিলেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজন সহচর, যিনি কয়েকবার বিএনপির টিকিটে ফেনী থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া বিএনপির সময়ে তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গার্মেন্টস সেক্টরের প্রধান সংগঠন বিজিএমইএ এর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সূত্র আরো জানায়, এই মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন যুদ্ধাপরাধী হিসাবে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একটি সূত্র মারফত জানা যায়, মোয়াজ্জেম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে মিলে ২০০৬ সালে সিরাজগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ আটকে দেন। মূলত আওয়ামীলীগ হিসেবে পরিচিত সামিট গ্রুপ এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ পাওয়ায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নালিশ করেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন বাতিল করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। জনশ্রুতি আছে, মোয়াজ্জেম এর পাকিস্তান কানেকশন নিয়েও ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। তিনি পাকিস্তানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। এমনকি তার ছেলে একজন পাকিস্তানি কে বিয়েও করেছেন।
এ জাতীয় আরো খবর..