গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর দলের জাতীয় কমিটির সভায় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে সাময়িক বহিষ্কার হওয়া নেতাদের সাধারণ ক্ষমা করে আওয়ামী লীগ।
এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত শতাধিক নেতাকে সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছে
একবার নয়, পরপর দুবার দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। সর্বশেষ গত মে মাসে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি তাঁর মা জায়েদা খাতুনকে স্বতন্ত্র প্রার্থী করার দায়ে স্থায়ী বা আজীবন বহিষ্কৃত হন। জাহাঙ্গীরের মা আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে ভোটে হারিয়ে গাজীপুর সিটির মেয়র নির্বাচিত হন। ছেলে জাহাঙ্গীরের চোখ এখন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির পদের দিকে।
জাহাঙ্গীরের চাওয়া পূর্ণ হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে মনে করেন। কারণ, দলের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে তাঁকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। এরপরই গত মাসে ঢাকায় আওয়ামী লীগের ‘শান্তি সমাবেশে’ বিপুল সংখ্যাক লোক নিয়ে এসেছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। সর্বশেষ ঢাকার প্রবেশমুখে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচির দিনও টঙ্গী-আবদুল্লাহপুর এলাকায় জাহাঙ্গীরের লোকজনের ব্যাপক তৎপরতা দেখা গেছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, গত ১৫ বছরের শাসনামলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নানা কারণে দলের দায়িত্বশীল বেশ কয়েকজন নেতা, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের দল থেকে বহিষ্কার করেছে। এর মধ্যে আলোচিত হলেন সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান, গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, ক্যাসিনো–কাণ্ডে নাম জড়ানো ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। দলীয় কোন্দলে গত বছর বরিশালের সংসদ সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ নাথকে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর দলের জাতীয় কমিটির সভায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সাময়িক বহিষ্কার হওয়া দলীয় নেতাদের সাধারণ ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ। তখন শতাধিক নেতা ক্ষমা পান। এরপরও অনেকে আবেদন করেছেন।
গত মাসে ঢাকায় আ.লীগের ‘শান্তি সমাবেশে’ বিপুলসংখ্যক লোক নিয়ে আসেন জাহাঙ্গীর আলম। পদ ফিরে পেতে বহিষ্কৃত অনেকের আবেদন
আলোচনায় জাহাঙ্গীর
২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সে সময় গোপনে ধারণা করা হয়, জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে বহিষ্কার করা হয় তাঁকে। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও গাজীপুর জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করেন তিনি। এরপর তাঁকে মেয়র পদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে পরের বছর ২০২২ সালের ১৯ নভেম্বরগাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতি পদে মো. আজমত উল্লা খান এবং সাধারণ সম্পাদক পদে আতাউল্লাহ মণ্ডল নির্বাচিত হন। এর ফলে জাহাঙ্গীর আলমের দলে ফেরার পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
গত ২১ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ ক্ষমার চিঠি পান জাহাঙ্গীর আলম। এরপর থেকেই মেয়র পদ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালান তিনি। কিন্তু সরকার তাঁকে মেয়র পদ ফিরিয়ে দেয়নি।
এর মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে জাহাঙ্গীর আলম নিজে প্রার্থী হন এবং পাশাপাশি তাঁর মা জায়েদা খাতুনকে স্বতন্ত্র প্রার্থী করেন। শেষমেশ তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হয়। মা স্বতন্ত্র প্রার্থী থেকে যান।
দলের জাতীয় কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্তে একসঙ্গে শতাধিক বহিষ্কৃত নেতাকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর আরও যেসব আবেদন এসেছে, সেগুলোর কিছু বিবেচনাধীন।
মাহবুব উল আলম হানিফ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
গত ২৫ মে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন জায়েদা খাতুন। আসলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকসহ প্রায় সবারই মত হচ্ছে—জাহাঙ্গীর আলমই দলীয় প্রার্থীকে হারিয়েছেন। অবশ্য ভোটের আগে ১৫ মে জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগ।
সেই ভোটের পর পরাজিত আজমত উল্লাকে গত ৪ জুন গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তাঁর নিয়োগের আদেশে বলা হয়েছে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্মসম্পর্ক পরিত্যাগ করতে হবে। এই শর্তেই তাঁকে তিন বছরের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। আজমত উল্লা এখনো গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি।
আজমত উল্লার গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হওয়ার ক্ষেত্রে ‘অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্মসম্পর্ক পরিত্যাগের’ যে শর্ত রয়েছে, এই অংশকে নিজের সুযোগ হিসেবে দেখছেন জাহাঙ্গীর আলম। এই সুযোগ নিয়ে তিনি এখন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে দল থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। তিনিও দলের পক্ষেই কাজ করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পদ-পদবি না থাকলেও দলের ভেতর পদ হারানো বা বহিষ্কৃত নেতাদের প্রভাব রয়েছে। সেটি বিবেচনায় নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
অন্যদের কী অবস্থা
জাহাঙ্গীর আলমের ঘটনার কিছুদিন পরই অশালীন ও নারীর প্রতি অবমাননাকর কথা বলে মন্ত্রিত্ব ও দলের পদ হারান সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। জাহাঙ্গীর আলমের আগে রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলীকেও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেওয়ার কারণে। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারেও পাঠানো হয়। মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হন তিনি। এখন তিনি জামিনে মুক্ত। আব্বাস ক্ষমার আবেদন করেননি বলে জানা গেছে। মুরাদ হাসান আবেদন করেছেন; কিন্তু মুরাদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি যে ক্ষমার আবেদন করেছিলেন, এ বিষয়ে দল থেকে কোনো কিছু জানায়নি। এখন তিনি সংসদ সদস্য হিসেবেই দায়িত্ব পালন করছেন।
এর আগে পবিত্র হজসহ ধর্মীয় নানা বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে ২০১৪ সালে প্রথমে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন লতিফ সিদ্দিকী। তখন তাঁকে দলের সভাপতিমণ্ডলী ও সাধারণ সদস্যপদ থেকেও বাদ দেওয়া হয়। দলের চাপে তিনি সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে তিনি রাজনীতি থেকে আড়ালেই আছেন।
গত বছর সেপ্টেম্বরে বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথকে দলের সব ধরনের পদ থেকে অব্যাহতি দেয় আওয়ামী লীগ। দলীয় সূত্র বলছে, তাঁর অব্যাহতি ছিল প্রতীকী। পঙ্কজ নাথ প্রথম আলোকে বলেন, গত ডিসেম্বরে কেন্দ্র থেকে সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে তিনি নিজে এর আওতায় পড়েন। এ জন্য আলাদা করে আর তিনি আবেদন করেননি।
ক্যাসিনো–কাণ্ড
২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান শুরু করে সরকার। এই অভিযান চলে মাস দেড়েক। এ সময় ঢাকা মহানগর যুবলীগের তৎকালীন সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটসহ ১৩ জন গ্রেপ্তার হন। অনেকে সে সময় দেশ ছাড়েন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হওয়ার পর যুবলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ, যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য মিজানুর রহমানসহ অনেকে দেশেও ফেরেন।
কারাগার থেকে এখন জামিনে মুক্ত রয়েছেন ইসমাইল হোসেন, খালেদা ভূঁইয়াসহ অনেকে। বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীম এখনো কারাগারে। ক্যাসিনো–কাণ্ডের পর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাউসার, যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতারা দলীয় পদ হারান।
যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগসহ সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতা বহিষ্কৃত হন কিংবা দলীয় পদ হারান, তাঁদের বিষয়টি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ক্ষমার আওতায় পড়েনি। সহযোগী সংগঠনগুলোও তাঁদের বহিষ্কার প্রত্যাহার করেনি। তবে বহিষ্কৃত নেতারা দলে অবস্থান ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পদ-পদবি না থাকলেও দলের ভেতর পদ হারানো বা বহিষ্কৃত নেতাদের প্রভাব রয়েছে। সেটি বিবেচনায় নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
গত ১৫ বছরে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে আওয়ামী লীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কারের পর দলে ফিরে নেওয়া এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার উদাহরণ আছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সরকারবিরোধী আন্দোলন বিবেচনায় নিয়ে বহিষ্কৃত ব্যক্তিদের ক্ষমা করা হয়েছে।
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, দলের জাতীয় কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্তে একসঙ্গে শতাধিক বহিষ্কৃত নেতাকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর আরও যেসব আবেদন এসেছে, সেগুলোর কিছু বিবেচনাধীন।
এ জাতীয় আরো খবর..