কোভিডের পর ইনডোরে ঢুকে পড়েছে কনসার্ট। তার পর থেকেই দর্শক-শ্রোতার কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে শব্দবিভ্রাটের অভিযোগ। ঢাকার মিলনায়তনগুলো কনসার্টের জন্য কতটা উপযোগী?
‘ভিড়ের মধ্যে মিলনায়তনের পেছনে এক কোনায় দাঁড়ানোর জায়গা পেয়ে মেঘদলের গান শোনার চেষ্টা করলাম। ভয়েস পাচ্ছিলাম না; শুধু ড্রামস, গিটারের শব্দ। ভিড় ঠেলে সামনের দিকে গিয়ে ভয়েস পেয়েছি, সাউন্ডও ভালো ছিল,’ টিকিট কেটে ‘ম্যাজিক্যাল নাইট’ কনসার্ট শোনার অভিজ্ঞতা জানালেন বেসরকারি চাকরিজীবী আদনান মাহমুদ।
গত ৬ জুলাই ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার (আইসিসিবি) নবরাত্রি হলে আয়োজিত এই কনসার্ট ছাড়াও ‘লেটস ভাইব উইথ ঢাকা’, ‘এমপ্যাথি কনসার্ট ২০২৩’–সহ বেশির ভাগ ইনডোর কনসার্টেই মিলেছে শব্দবিভ্রাটের (সাউন্ড) অভিযোগ।
বিগত বছরগুলোতে আর্মি স্টেডিয়ামে ‘জয় বাংলা কনসার্ট’ ও ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার (আইসিসিবি) এক্সপ্রো জোনে হাতে গোনা কয়েকটি কনসার্ট ছাড়া ঢাকার ৯০ ভাগের বেশি কনসার্ট ইনডোরেই হয়। সবচেয়ে বেশি কনসার্ট হয় আইসিসিবির নবরাত্রি হলে; এর বাইরে আলোকি, কেআইবি কমপ্লেক্স মিলনায়তনসহ আরও কয়েকটি মিলনায়তনে কনসার্ট হয়। একসময় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে নিয়মিত কনসার্ট হলেও এখন আর হয় না।
ঢাকার মিলনায়তন কতটা উপযোগী
নব্বই থেকে শূন্য দশক—ব্যান্ডসংগীতের জমকালো সময়ে বেশির ভাগ কনসার্ট খোলা আকাশের নিচে হতো। আউটডোর কনসার্টে শব্দ নিয়ে শ্রোতাদের খুব একটা অভিযোগ ছিল না। কনসার্ট ইনডোরে প্রবেশের পর থেকেই মূলত শব্দবিভ্রাটের অভিযোগ সামনে আসছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কনসার্টের জন্য ঢাকায় ‘ডেডিকেটেড’ কোনো মিলনায়তন নেই। কনসার্টের জন্য বিয়েবাদ্যি, সমাবর্তন, সেমিনার আয়োজনের জন্য নির্মিত মিলনায়তনই একমাত্র ভরসা। ঢাকার বেশির ভাগ মিলনায়তনই কনসার্ট উপযোগী নয়। ফলে গাঁটের পয়সা খরচ করে টিকিট কেটে কনসার্টে গেলেও মন ভরছে না শ্রোতাদের, কখনো কখনো শব্দ-যন্ত্রণার কবলেও পড়তে হচ্ছে।
এলআরবির সাবেক শব্দপ্রকৌশলী শামীম আহমেদ ১৬ জুলাই বলেন, ‘ইনডোরের চারদিকে দেয়াল থাকে, ছাদ থাকে। ফলে কনসার্টের সাউন্ড রিফ্লেকশনটা খুব বেশি হয়। ফলে সাউন্ডে জটিলতা হয়। তবে ওপেন এয়ারে এমনটা হয় না।’
শব্দবিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনসার্টের জন্য প্রতিটি মিলনায়তনে ‘অ্যাকুস্টিক প্যানেল’ থাকা জরুরি; যন্ত্রটি শব্দের প্রতিধ্বনি (ইকো) রোধ করে শব্দকে শ্রুতিমধুর করে। আইসিসিবির নবরাত্রি হলে ঢাকার সবচেয়ে বেশি কনসার্ট হলেও সেখানে কোনো অ্যাকুস্টিক প্যানেল নেই। ভালো শব্দ পেতে মিলনায়তনে প্যানেলটি স্থাপন জরুরি।
তবে আপাতত নবরাত্রি হলে অ্যাকুস্টিক প্যানেল স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছে আইসিসিবি। প্রতিষ্ঠানটির অপারেশনস বিভাগের কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম ১৮ জুলাই বলেন, ‘কনসার্টের জন্য আমাদের এক্সপ্রো জোন (আউটডোর) রয়েছে; আর হলগুলো মূলত করপোরেট শো করার জন্য করা হয়েছে।’
এর বাইরে আলোকি মিলনায়তনেও অ্যাকুস্টিক প্যানেল না থাকার খবর মিলেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলী রাশেদুল হক ১৯ জুলাই প্রথম আলোকে জানান, তাঁদেরও প্যানেলটি স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা নেই।
ঢাকায় কনসার্ট উপযোগী একমাত্র মিলনায়তন কেআইবি কমপ্লেক্স মিলনায়তন। সরকারি মিলনায়তনটিতে অ্যাকুস্টিক প্যানেল থাকায় শ্রোতারা মন ভরে সংগীত উপভোগ করতে পারেন। তবে শ্রোতাদের ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় কেআইবি মিলনায়তনে খুব বেশি কনসার্ট হয় না।
ঢাকায় কনসার্ট উপযোগী একমাত্র মিলনায়তন কেআইবি কমপ্লেক্স মিলনায়তন। সরকারি মিলনায়তনটিতে অ্যাকুস্টিক প্যানেল থাকায় শ্রোতারা মন ভরে সংগীত উপভোগ করতে পারেন। তবে শ্রোতাদের ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় কেআইবি মিলনায়তনে খুব বেশি কনসার্ট হয় না। এর ধারণক্ষমতা ৯০০, আইসিসিবির নবরাত্রি হলের ধারণক্ষমতা ৯ হাজারের মতো। মুনাফার আশায় কনসার্ট আয়োজনে নবরাত্রিকেই বেছেন নেন আয়োজকেরা।
কেআইবি কমপ্লেক্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জুবায়েদ আল হাফিজ ১৮ জুলাই বলেন, ‘ভালো সাউন্ড পাওয়ার জন্য যেকোনো মিলনায়তনে অ্যাকুস্টিক প্যানেল থাকতে হয়। আমাদের মিলনায়তনের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই সেটি রয়েছে।’ মিলনায়তনটি মূলত সরকারি সেমিনার আয়োজনের জন্য নির্মিত হয়েছে। তবে ২০১৫ সাল থেকে টুকটাক কনসার্টও হয়।
মিলনায়তনে অ্যাকুস্টিক প্যানেল না থাকলেও শব্দ নিয়ন্ত্রণ করে শব্দবিভ্রাট খানিকটা কমানো যায়। কনসার্টে কনসোল, স্পিকারসহ যাবতীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও শব্দ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ব্লুজ প্রোডাকশন, এসএএস, এপি রিদম, সাউন্ড মেশিন, রোয়ার, সাউন্ড এক্সপ্রো, স্ক্রিমসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
শব্দ নিয়ন্ত্রণেও কনসার্ট আয়োজক প্রতিষ্ঠানের গা ছাড়া ভাব রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। শামীমের ভাষ্যে, ‘বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো ইকুইপমেন্ট রয়েছে। ভালো বাজেট দিলে ভালো ইকুইপমেন্ট পাওয়া সহজ। কিন্তু আয়োজকেরা বাজেটে কাটছাঁট করেন।’
পাশাপাশি ভেন্যুতে যন্ত্রপাতি স্থাপনেও সীমিত সময় পান শব্দ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। শামীম আহমেদ বলছেন, ‘সাউন্ড ইকুইপমেন্ট বসাতে বেশ সময় লাগে, সেই সময় পাওয়া যায় না। রাতভর ইকুইপমেন্ট বসানোর পর পরদিন চেক না করেই শো শুরু করতে হয়। ফলে সাউন্ডে জটিলতা দেখা যায়।’
স্কাই ট্র্যাকার লিমিটেড, দ্য হাইব্রিড এক্সপেরিয়েন্স, ব্যান্ডমিথ এক্সপেরিয়েন্টাল, সিক্সবেজ কমিউনিকেশন, ট্রিপল টাইম কমিউনিকেশনস, এডভেন্টর কমিউনিকেশনস, ঢাকা ব্রডকাস্টসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঢাকায় নিয়মিত কনসার্ট আয়োজন করে।
এ জাতীয় আরো খবর..