দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নামে প্রতারণা চলছেই। কমিশনের পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করা হলেও বন্ধ হচ্ছে না প্রতারণা। দুর্নীতি দমনে নিয়োজিত এ প্রতিষ্ঠানটির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশেই গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি চক্র। প্রতিটি চক্রে রয়েছে ৫-৭ জন করে সদস্য। বেশ কয়েক বছর ধরে তারা দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। তাদের টার্গেট মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য (এমপি), দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও বিত্তশালী ব্যক্তি। প্রতারক চক্রের হাত থেকে দুদককে রক্ষা করতে ইতোমধ্যে একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে কমিশন। তারপরও লাগাম টানা যাচ্ছে না শক্তিশালী ওই সিন্ডিকেট সদস্যদের। তাই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে মামলা করেছে দুদক। তবে মামলায় অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে। রোববার দুদক উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে রমনা থানায় এ মামলা করেন। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এদিকে দুদককে ঘিরে যে প্রতারক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে তা নিয়ে গত দুই মাস ধরে তদন্ত চালাচ্ছে ঢাকা মহনাগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রোববার যে মামলাটি হয়েছে সেটি নিয়েও ডিবি ইতোমধ্যে ছায়া তদন্ত করেছে। এর আগে গত ২৩ জুন অভিযান চালিয়ে দুদক মানিলন্ডারিং শাখার মহাপরিচালকের পিএসসহ চারজনকে গ্রেফতার করে ডিবি। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে ডিএমপির এই গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত সংস্থা। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতারক সিন্ডিকেটের মূল হোতা দুদকের একজন উপপরিচালক। এই মুহূর্তে তার সহযোগীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তাদের গ্রেফতারের পরই মূল হোতাকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে যুগান্তরকে জানিয়েছে ডিবির নির্ভরযোগ্য সূত্র। সূত্র আরও জানায়, চক্রের সদস্যদের মধ্যে আছে রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ী, বেকার যুবক, নামধারী সাংবাদিক, দুদকে একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের আত্মীয়স্বজন।
ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যে চক্র গড়ে উঠেছে তাদের একজনের একটি পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, প্রথম শ্রেণির জাতীয় পত্রিকার নামে তৈরি করা ওই পরিচয়পত্রটি ভুয়া। সেখানে তার পদমর্যাদা লেখা হয়েছে ‘মার্কেটিং অ্যান্ড রিপোর্টার’। পরিচয়পত্রে নাম দেওয়া হয়েছে এমডি সোহাগ পাটোয়ারী। সূত্র আরও জানায়, তদন্তে দুদকের যে উপপরিচালকের নাম পাওয়া গেছে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক। তিনি নিজে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হলেও তার সহযোগীদের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করেন। তাদের নামে ভুয়া নোটিশ পাঠিয়ে তা নিষ্পত্তি করার নামে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করেন। কখনো কখনো কমিশন অনুমোদিত নোটিশের কপিও তাদের (প্রতারক সিন্ডিকেট) হাতে চলে যায়।
ডিবি জানায়, প্রথমে চক্রের সদস্যরা টার্গেট করা ব্যক্তি মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে। পরে তাদের কাছে সোর্স পাঠায়। কখনো নিজেরাই হাজির হন। টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের কাছে ফোন করেন দুদক কমিশনার, মহাপরিচালক (ডিজি), পরিচালক ও উপপরিচালক পরিচয়ে। কমিশনার এবং ডিজি পরিচয়ে ফোন করার সময় তারা নিজেদের কমিশনার ও ডিজির পিএ বা পিএস পরিচয়ে ফোন দেন। পিএস পরিচয়ে ফোন করার সময় টার্গেট করা ব্যক্তিকে স্যার বলে সম্বোধন করেন। আর পরিচালক-উপপরিচালক পরিচয়ে ফোন দিলে ভাই বলে সম্বোধন করেন। বলা হয়, আপনার নামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে যাচাই করা হয়েছে। কমিশনের কাছে স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে, আপনি বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের মালিক। ‘অমুক’ তারিখে আপনাকে দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। আপনি নির্দিষ্ট তারিখে আসবেন, নাকি এর আগেই এসে আপনার কোনো কথা থাকলে তা বলে যাবেন?
ডিবি আরও জানায়, কেউ নির্দিষ্ট তারিখের আগে কথা বলতে রাজি হলে তাকে সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ের সামনে আসতে বলা হয়। দুদকের সামনে এসে ওই ব্যক্তি ফোন দিলে বলা হয়, কার্যালয়ের ভেতরে সিসি ক্যামেরা আছে। আপনার এখানে আসার দরকার নেই। আপনি অফিসের সামনে দাঁড়ান। আমি লোক পাঠাচ্ছি। এরপর সেখানে দালাল পাঠিয়ে অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়ার নামে অর্থ আদায় করা হয়। বেশিরভাগ সময় ক্যাশ অথবা নগদ অ্যাপসের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, গত জুনে আশিকুজ্জামান নামে এক ব্যবসায়ীর নামে ভুয়া নোটিশ দিয়ে ঘুস আদায়ের সময় আমরা দুদকের একজন ডিজির পিএকে হাতেনাতে গ্রেফতার করি। তার সঙ্গে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করি। ওই তিনজনের মধ্যে একজন চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যও আছে। গ্রেফতারকৃত চারজনের কাছ থেকে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাই। ওইসব তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তদন্ত অব্যাহত রাখি। আশা করছি, দ্রুত আরও বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করতে পারব।
রমনা থানায় করা মামলার এজাহারে দুদক উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম উল্লেখ করেন, প্রতারক চক্রের সদস্যরা দুদক পরিচয়ে চাঁদাবাজি ও অর্থ আত্মসাৎ করছে। এ কাজে তারা দুদকের বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নাম পদমর্যাদা, ছবি ও দুদকের লোগো ব্যবহার করছে। মোবাইল কল, হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন অনলাইনে আইডি খুলে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। দুদকের মনোগ্রাম ও সিল জাল করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ব্যাংক হিসাব, বিকাশ এবং নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ছাড়া নগদ টাকাসহ নানা ধরনের অনৈতিক সুবিধা আদায় করছে। এজাহারে বেশ কয়েকটি মোবাইল নম্বর উল্লেখ করে বলা হয়, দুটি নম্বর ব্যবহার করে দুদক মহাপরিচালক রেজানুর রহমানের নামে, একটি করে পৃথক নম্বর দিয়ে কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান, উপপরিচালক মনিরুজ্জামান, আবুবকর সিদ্দিকের নাম ব্যবহার করে মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা দাবি করা হচ্ছে। এতে কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
ডিবি লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, দুদককে ঘিরে যে প্রতারক চক্র গড়ে উঠেছে সে বিষয়ে দুদক এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমরা অনেক অভিযোগ পাচ্ছি। আমরা সেগুলো যাচাই করছি। দুদকের গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখতে এবং মানুষকে হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করতে আমরা কাজ চলমান রেখেছি।
এ জাতীয় আরো খবর..