ভারী বর্ষণ ও পূর্ণিমার অস্বাভাবিক জোয়ারে গতকাল রোববার টানা তৃতীয় দিনের মতো ডুবল দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত চট্টগ্রাম নগর। তিন দিনের জলাবদ্ধতায় নগরের অন্তত ৪০ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। রাস্তাঘাট, অলিগলি ও বসতঘর ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকায় নগরের অন্তত ১৫ লাখ মানুষ অসহনীয় কষ্টের শিকার হন। ক্ষতির মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা।
চলতি বছরের সাত মাসে ১০ বার ডুবল চট্টগ্রাম নগর। আগের বছর ডোবে ১২ বার। ভুক্তভোগীদের মতে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবারের জলাবদ্ধতার ব্যাপকতা ছিল সবচেয়ে বেশি।
এবার জলাবদ্ধতায় দেশের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে তেমন ক্ষতি না হলেও অলিগলির দোকান, বিপণিকেন্দ্র ও কাঁচাবাজার পানিতে তলিয়ে যায়। দোকানপাটের মালামাল পানিতে নষ্ট হয়ে যায়। তিন দিনে কত টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে ব্যবসায়ীদের ধারণা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ১৫০ কোটি টাকা।
তিন দিন ধরে পানি জমে রয়েছে। কোনোরকম সেচে পানি কমাই। এরপর রান্না করি। আবার পানি উঠে যায়। বাচ্চাদের নিয়ে খুব কষ্টে আছি।
গৃহিণী ফারজানা আক্তার
২০২১ সালে এক গবেষণায় উঠে আসে, জলাবদ্ধতার কারণে শুধু খাতুনগঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় এক বছরে ৪৬৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে এ যাত্রায় রক্ষা পেলেও যেভাবে বৃষ্টি ও জোয়ার হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় আছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।
ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে জলাবদ্ধতা যাতে না হয়, সে জন্য অনেক ব্যয়বহুল উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশনের একটি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) দুটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পের আওতায় ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার কাজ চলছে। এর মধ্যে গত ৬ বছরে ৫ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা খরচ হলেও খুব বেশি সুফল আসেনি। জোয়ার ঠেকাতে নগরের বিভিন্ন খালের মুখে ৪০টি জলকপাটের (স্লুইসগেট) মধ্যে মাত্র ৫টির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৩৫টির কাজ ছয় বছর ধরেই চলছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার বেলা তিনটা থেকে গতকাল বেলা তিনটা) চট্টগ্রামে ২৩১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ভারী বর্ষণের পাশাপাশি জোয়ারের উচ্চতাও ছিল বেশি। চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাবে গতকাল সদরঘাট এলাকায় ভোরের সময় কর্ণফুলী নদীতে জোয়ারের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে দশমিক ৫০ মিটার বেশি ছিল। জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৫ দশমিক ১৬ মিটার। বিকেলে জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৫ দশমিক ১১ মিটার।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছরের মধ্যে গতকাল সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। লঘুচাপের কারণে এই বৃষ্টি আরও কয়েক দিন চলবে।
নগরের রেয়াজউদ্দিন বাজার এলাকায় তেমন জলাবদ্ধতা হতো না। এবার তিন দিন ধরে সেখানে জলাবদ্ধতায় প্রায় দুই কোটি টাকার জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের বড় ক্ষতি
ভারী বর্ষণে শুক্রবার ভোর থেকে নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা শুরু হয়। জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকার একটি ছিল নগরের চকবাজারের কাঁচাবাজার এলাকা। শুক্রবার থেকে এই এলাকার চক সুপার মার্কেট বন্ধ রয়েছে। গতকালও খোলেনি।
চক সুপার মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা বেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বিপণিবিতানের নিচতলায় পোশাক, প্রসাধন সামগ্রী, ক্রোকারিজ, মুঠোফোনের ৫৫টি দোকান রয়েছে। প্রথম দিন অন্তত ৩০টি দোকানের প্রায় ২০ লাখ টাকার মালামাল নষ্ট হয়েছে। আবার পানির কারণে তিন দিন ধরে বিপণিবিতান বন্ধ।
নগরের ওয়াই ডব্লিউ সি এ প্রাইমারি স্কুল, এখলাছুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাপাসগোলা সরকারি প্রাথমিক বালক বিদ্যালয়সহ ছয়টি স্কুলের নিচতলা ডুবেছে।
চক সুপার মার্কেটের পাশে ফলের দোকান রয়েছে মোহাম্মদ শামসুল আলমের। গতকাল সকালে দেখা যায়, দোকানের ভেতর হাঁটুপানি। মোটর দিয়ে পানি পরিষ্কার করছিলেন তিনি। এর ফাঁকে প্রথম আলোকে বলেন, পানিতে দোকানের দুই লাখ টাকার ফলমূল ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিবারই এ ধরনের ক্ষতির শিকার হতে হয়। এবার বেশি ক্ষতি হয়ে গেল।
শামসুল আলমের বিপরীত পাশে রয়েছে যাদব পালের কাপড়ের দোকান। প্রথম দিনের জলাবদ্ধতায় তাঁর দোকানের ১৫ হাজার টাকার কাপড় ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। পরদিন থেকে সতর্ক থাকায় আর কাপড় নষ্ট হয়নি। কিন্তু বেচাবিক্রিও নেই।
জলাবদ্ধতায় এবার ডুবেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর এলাকা বহদ্দারহাটও। এই এলাকার স্বজন সুপার মার্কেটের নিচতলা গত তিন দিনই পানিতে ডুবে ছিল। ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. দেলাওয়ার হোসেন বলেন, মার্কেটের নিচতলায় বিভিন্ন পণ্যের প্রায় ১০০ দোকান রয়েছে। তিন দিনের জলাবদ্ধতায় প্রায় ৪০ লাখ টাকার মালামাল নষ্ট হয়েছে।
নগরের রেয়াজউদ্দিন বাজার এলাকায় তেমন জলাবদ্ধতা হতো না। এবার তিন দিন ধরে সেখানে জলাবদ্ধতায় প্রায় দুই কোটি টাকার জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। শাড়ির দোকানি আনোয়ার হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নালা-নর্দমা সব বন্ধ। বৃষ্টিতে পানি দোকানে ঢুকে এক লাখ টাকার শাড়ি নষ্ট হয়েছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির চট্টগ্রাম শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছরই জলাবদ্ধতার কারণে ব্যবসায়ীরা নানাভাবে ক্ষতির শিকার হন। প্রথমত দোকানের জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যায়। এরপর জলাবদ্ধতার সময় ব্যবসা বন্ধ থাকে। এবার প্রায় পাঁচ হাজার দোকানি জলাবদ্ধতার শিকার হন। এতে অন্তত দেড় শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তাঁদের ধারণা।
চট্টগ্রাম শহরে মানুষ বাড়ছে। অবকাঠামোও বাড়ছে। সে তুলনায় বৃষ্টির পানির প্রবাহ সচল রাখতে নালা-নর্দমা-খাল পরিষ্কার রাখা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করাসহ তদারকি বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বাড়েনি। এ বিষয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর জবাবদিহি থাকতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান
খাতুনগঞ্জে ক্ষতি কম, তবু শঙ্কা
গত বছরের ২৪ অক্টোবর রাতের অস্বাভাবিক জোয়ারে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের অনেক দোকান ও গুদামে পানি ঢুকে পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা বিপুল আর্থিক ক্ষতির শিকার হন। এবার ভারী বর্ষণে খাতুনগঞ্জের রাস্তায় একদফা পানি উঠলেও নেমে যায়।
জোয়ার বা ভারী বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় হামিদুল্লাহ মিঞা বাজারের কাঁচা পণ্যের আড়তে। খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লাহ মিয়া মার্কেট কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ ইদ্রিস প্রথম আলোকে বলেন, এবার জোয়ারের সময় চাক্তাই খালের স্লুইসগেট বন্ধ ছিল। জোয়ারের পানি খাতুনগঞ্জে ঢুকতে পারেনি। ভারী বর্ষণে পানি উঠলেও তাতে খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবু ভয় কাটছে না। কারণ, গত বছর বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।
২০২১ সালে চট্টগ্রাম চেম্বারের সহযোগিতায় সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের ন্যাশনাল রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) যৌথ উদ্যোগে করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, অতিবৃষ্টি বা জোয়ারের পানির কারণে জলাবদ্ধতায় দেশের বড় পাইকারি এ বাণিজ্যকেন্দ্রে এক দশকে (২০১১-২০২০) ২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে খাতুনগঞ্জ ও আশপাশের বাণিজ্য এলাকার সাড়ে চার হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ৪৬৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এরপর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আর কোনো জরিপ বা গবেষণা হয়নি।
নিচু এলাকার মানুষ বেশি কষ্টে
জলাবদ্ধতার কারণে সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়েন নিচু এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের ঘরের নিচতলা পানিতে তলিয়ে যায়। ভারী বৃষ্টি হলে প্রথমেই ডোবে চকবাজার। এ এলাকায় আধা পাকা ভবনের ভাড়া বাসায় স্বামী ও দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে থাকেন গৃহিণী ফারজানা আক্তার। তিনি বলেন, ‘তিন দিন ধরে পানি জমে রয়েছে। কোনোরকম সেচে পানি কমাই। এরপর রান্না করি। আবার পানি উঠে যায়। বাচ্চাদের নিয়ে খুব কষ্টে আছি।’
একই এলাকার গৃহিণী রোকসানা আক্তারের ঘরেও পানি জমে ছিল। পানি থেকে রক্ষায় ফ্রিজ রেখেছেন বড় টুলের ওপর। তিনি বসে ছিলেন আরেকটি টুলের ওপর। তিনি বলেন, তিন দিন ধরে পানি ঘরে। এর মধ্যে রান্না করতে হচ্ছে।
কাল চট্টগ্রাম নগরের প্রধান সড়ক মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটু পরিমাণ পানিতে ডুবে ছিল। সড়কটিতে কার্যত যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শুধু সিডিএ অ্যাভিনিউ নয়, নগরের কাপাসগোলা, কে বি আমান আলী সড়ক, সিরাজদ্দৌলাহ সড়ক, খাজা সড়কসহ বেশ কয়েকটি সড়কে যান চলাচল বিকেল পর্যন্ত কার্যত বন্ধ ছিল।
নগরের ওয়াই ডব্লিউ সি এ প্রাইমারি স্কুল, এখলাছুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাপাসগোলা সরকারি প্রাথমিক বালক বিদ্যালয়সহ ছয়টি স্কুলের নিচতলা ডুবেছে।
কাপাসগোলা সরকারি প্রাথমিক বালক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সলিকা বেগম বলেন, বিদ্যালয়ের নিচতলা পুরোটাই পানির নিচে। সকালে পাঁচ-সাতজন শিক্ষার্থী এসেছিল। তাদের বাড়ি পাঠিয়ে শিক্ষকেরা ফিরে গেছেন। খাজা রোড এলাকায় ওয়াই ডব্লিউ সি এ প্রাইমারি স্কুলের অভিভাবক নাজনীন সুলতানা বলেন, ‘বহদ্দারহাট থেকে খাজা রোড পুরো এলাকায় হাঁটুসমান পানি। পরীক্ষা থাকায় বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে এসেছি।’
দায় এড়ানো চলছেই
মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সিডিএ তাদের প্রকল্পের আওতাধীন খালগুলো থেকে যে পরিমাণ মাটি (সাড়ে ৯ লাখ ঘনমিটার) উত্তোলনের কথা, তার চার ভাগের এক ভাগও তোলেনি। রাস্তা করার জন্য খালের প্রশস্ততা কমিয়েছে। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ মাটি উত্তোলন না করায় খালের গভীরতাও কমেছে। তাতে পানিপ্রবাহের পরিমাণ কমে গেছে। এ ছাড়া জলকপাটগুলো এখনো চালু হয়নি। পাম্পের মাধ্যমে পানিনিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা করেনি। এসব কারণে জলাবদ্ধতা হচ্ছে।
তবে এই দাবি অস্বীকার করে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রকল্পের আওতায় খালগুলো ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন নালাগুলো পরিষ্কার করেনি। যার কারণে নালা থেকে খালে পানি নামতে পারছে না। এতে জলাবদ্ধতা হচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম শহরে মানুষ বাড়ছে। অবকাঠামোও বাড়ছে। সে তুলনায় বৃষ্টির পানির প্রবাহ সচল রাখতে নালা-নর্দমা-খাল পরিষ্কার রাখা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করাসহ তদারকি বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বাড়েনি। এ বিষয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর জবাবদিহি থাকতে হবে।
এ জাতীয় আরো খবর..