‘গাছ পড়ে ঘরের চালা ভেঙে পড়লে যে রকম হয়, চ্যাপটা হয়ে থাকে, ঠিক সেভাবে ছিলাম। আর কয়েক ইঞ্চি দেবে গেলে সব শেষ। কোনোরকমে কাত হয়ে ছিলাম। সামনের আসনটির নিচে আটকা পড়ে আমার বাঁ পা। উরুর কাছে দুই বছরের ছোট মেয়েটি। শুধু আল্লাহকে ডেকেছি।’
দুবাইফেরত আবু বক্কর (৪০) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে আস্তে আস্তে এভাবে ঘটনার বর্ণনা দেন।
আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সামনে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে কনটেইনারসহ একটি লরি কাত হয়ে তাঁদের প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে। এ সময় গাড়িতে ছিলেন বক্কর, তাঁর দুই মেয়ে, শ্বশুর ও গাড়ির চালক। তবে সৌভাগ্যক্রমে বড় মেয়ে ৬ বছরের আদিবা ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে বের হতে পেরেছিল। বাকিরা আটকা পড়েন কারের ভেতর। দুমড়েমুচড়ে যাওয়া প্রাইভেট কারের ভেতর এভাবে দুই ঘণ্টা থাকার পর তাঁদের উদ্ধার করা হয়।
মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন বক্করসহ আরোহীরা। ১৮ মাস পর বক্কর দুবাই থেকে ফিরেছেন। তাঁকে আনতেই গাড়ি ভাড়া করেছিলেন শ্বশুর। যাওয়ার সময় সঙ্গে বাবাকে দেখাতে দুই নাতনিকেও নিয়ে যান। বক্করকে নিয়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফটিকছড়ির লেলাং ইউনিয়নের বাড়িতে ফিরছিলেন সবাই। পথেই এ বিভীষিকার মুখোমুখি হন।
বক্কর ও শ্বশুর মুছা এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। পা এবং বুকে ব্যথা পেয়েছেন বক্কর। মুছা ঘাড়ে ব্যথা পান। বাকিরা সুস্থ রয়েছেন।
বিকেলে যখন বক্করের সঙ্গে কথা হয়, তখনো তাঁর চোখেমুখে আতঙ্ক। সদ্য মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা বক্কর বলেন, ‘সকাল সাড়ে সাতটায় বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজে বিমানবন্দরে নামি। সকাল ১০টার দিকে বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে রওনা হই। ছোট মেয়ে আদিলা ছিল আমার কোলে। বড়টি বাঁ পাশে। শ্বশুর চালকের পাশের আসনে বসেছিলেন। আধঘণ্টা পর ফৌজদারহাট এলাকায় হঠাৎ এই ঘটনা ঘটে। তখন বৃষ্টি ছিল।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী লরিটি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী ছিল। কারটিও পাশে যাচ্ছিল। এ সময় লরিটি সড়ক বিভাজকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে কনটেইনারসহ কারের ওপর পড়ে। এতে গাড়িটি চাপা খায়। কনটেইনারের ওজন প্রায় ৩০ টন হবে বলে ধারণা।
আবু বক্কর বলেন, ‘কী পড়েছে, বুঝিনি। বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বাঁ দিকের দরজা খুলে যায়। আমার বড় মেয়ে নেমে পড়ে। ভাগ্যিস ওই সময় রাস্তায় অন্য গাড়ি ছিল না। তাহলে মেয়েটির সমস্যা হতো। আমি গাড়ির ভেতর কাত হয়ে থাকি। সামনের আসনের অংশ বুকে এসে চাপা দেয়। ছোট মেয়েটি দুই উরুর মাঝখানে। পা আটকে যাওয়ায় বের হতে পারছিলাম না। চালকসহ চারজনই আটকা পড়ি।’
দুর্ঘটনার পরপর চারদিক থেকে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসেন। কিন্তু এমন ঝুঁকিপূর্ণভাবে কনটেইনারটি গাড়িটিকে চেপে ধরেছিল যে তাঁদের পক্ষে উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব ছিল না। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। এভাবে মিনিট পেরিয়ে ঘণ্টা যায়, কেউ আসে না। গাড়ির ভেতর আরোহীরা চিৎকার করতে থাকেন। একপর্যায়ে হাইওয়ে পুলিশ আসে।
বক্কর বলে যান, ‘আমি প্রথমে চিৎকার করেছি। পরে আল্লাহকে ডেকেছি। ছোট মেয়েটি প্রথমে কান্না করে। পরে তাকে সাহস দিই। পুলিশ এসে উদ্ধারকাজ শুরু করে।’
উদ্ধারকাজ শুরু হওয়ার পর আরেক আশঙ্কা পেয়ে বসে বক্করকে। কারণ, কনটেইনারটি গাড়িটির ওপর যেভাবে ছিল, তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এদিক সেদিক হলেই শেষ। বাইরে থেকে শুধু সাদা কারটির সামান্য অংশ দেখা যাচ্ছিল।
বক্কর বলেন, ‘যখন ক্রেন লাগালো তখন খুব ভয় পাই। কারণ, আমি আর নিচু হতে পারছিলাম না। গাড়ির চালা আমার মাথাসহ ঘাড় চেপে ধরেছে। উদ্ধারের সময় যদি আর এক দু ইঞ্চি দেবে যায়, তাহলে মৃত্যু অনিবার্য। অবশেষে দুই ঘণ্টা পর আব্বা আম্মার দোয়ায় আমরা বেঁচে ফিরেছি।’
শয্যার কাছে এসে বাবাকে হাতের ক্ষত দেখাচ্ছে আদিবা। তার একটু হাত ছিলে গেছে।
শয্যার কাছে এসে বাবাকে হাতের ক্ষত দেখাচ্ছে আদিবা। তার একটু হাত ছিলে গেছে।ছবি: প্রণব বল
বক্করেরা পাঁচ ভাই দুই বোন। বক্কর ১৮ বছর ধরে দুবাই থাকেন। হাসপাতালে দেখতে ভাই হাসান ও বোন রেজিয়া এসেছেন। তাঁদের বেঁচে ফেরাটাকে সবাই অবিশ্বাস্য মনে করছেন। এর আগে ১০ মে নগরের পতেঙ্গা এলাকায় কনটেইনার চাপা পড়ে বাবা–ছেলের মৃত্যু হয়েছিল।
বক্করের ছোট্ট আদিলা বেশি ভয় পেয়েছে। সে বক্করের ভাই হাসানের কাঁধে মাথা দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আদিবা শয্যার কাছে এসে বাবাকে তার হাতের ক্ষত দেখাচ্ছে। তার একটু হাত ছিলে গেছে।
আবু বক্কর বলেন, ‘আমি যদি আজ মরে যেতাম, তাহলে ৩০টি পরিবার শেষ হয়ে যেত। দুবাইতে অনেক আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে গেছি। এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, বেঁচে আছি।’
এ জাতীয় আরো খবর..