এমরান মাহমুদ প্রত্যয়,আত্রাই(নওগাঁ)প্রতিনিধি: নওগাঁর রাণীনগরে পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও পৌষ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া পাঁচদিন ব্যাপী ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ “বয়লাগাড়ী” মেলা শুক্রবার শেষ হয়েছে। গত সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) বিকেল থেকে পারইল ইউনিয়নের বিলকৃষ্ণপুর গ্রামের উন্মুক্ত মাঠে পাঁচদিন ব্যাপী এই মেলা শুরু হয়েছিলো। অত্র অঞ্চলের মানুষরা বছর শেষে এই বয়লাগাড়ী মেলাকে ঘিরে বাড়িতে আনেন মেয়ে-জামাইকে। মেলার কারণে অত্র অঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতে উৎসবের ধূম পড়ে যায়। মেলা প্রাঙ্গন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
মেলার শুরুর দিনের দুপুর থেকেই নানা বয়সের মানুষ দল বেধে মেলায় আসেন। এই মেলার বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে নানা জাতের বড় বড় মাছ। সন্ধ্যার কিছু আগে এই মেলার মাছ পট্টিতে বিভিন্ন আকারের মাছ কেনার ধূম পরে যায়। বড় আকারের রুই-কাতলা মাছ ৪শ’ থেকে ৬শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এবার মেলায় ১৬কেজি ওজনের কাতল মাছ দেখা গেছে। কয়েক হাজার মণ মাছ বিক্রি হয় এই মেলায়। মেলায় এসে একটি মাছ না কিনলে মেলার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়া বলে মনে করেন মেলায় আসা দর্শনার্থীরা।
মেলার আরেক বিশেষ আকর্ষন হচ্ছে মেলার পরদিন বউ মেলা। বউ মেলায় শুধু মেয়ে ও জামাইদের আগমন ঘঠে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টির পসরা নিয়ে বসা মিষ্টির দোকান মেলার অন্যতম আরেকটি আকর্ষন। মেলায় আসা প্রতিটি মিষ্টির দোকানীরা দুইদিনে ৩০ লাখ টাকার বেশি টাকার মিষ্টি বিক্রি করেন বলে জানা গেছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে বর্তমানে মেলায় অনেক নতুন দোকানও স্থান পায়। মেলায় বড়দের পাশাপাশি ছোটদের জন্যও নাগর দোলাসহ বিভিন্ন ধরণের রাইড স্থান পায়। এছাড়া ফার্নিচার সামগ্রীর দোকান, ছোটদের খেলনার দোকান, চুরি ফিতার দোকানসহ হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ বিভিন্ন পণ্যের সামগ্রীর দোকানপাট বসে।
মেলাতে আসা উপজেলার কাটরাশাইন গ্রামের জামাই আজিজুল হক জানান, আমি এই মেলায় প্রতি বছরই আসি। মেলা থেকে এবার ৪শ’টাকা দরে ৬কেজি ওজনের কাতল মাছ কিনেছি। মেলার পরিবেশ অনেক ভালো। এতোবড় মেলায় এখন পর্যন্ত বড় ধরণের মারামারির ঘটনা ঘটেনি। এই মেলা হচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে একটি সুস্থ্য ধারার বিনোদনের নাম।
মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক টুকু বলেন ঐতিহ্যবাহী এই মেলার ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য আমরা সবাই স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে মেলার সকল কার্যক্রম শান্তিপূর্ণ ভাবে পরিচালনা করে আসছি। মেলা থেকে যে অর্থ আয় হয় সেই অর্থ অত্র অঞ্চলের গরীব মানুষদের চিকিৎসা সহায়তায়, গরীব-অসহায় মানুষদের মেয়ের বিয়ের খরচ হিসেবে, বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানার উন্নয়নকল্পে ব্যয় করা হয়। এছাড়া বর্তমান যান্ত্রিক জীবনে এই অঞ্চলের মানুষদের একটু সুস্থ্য বিনোদন দেবার লক্ষে মেলার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আসা হচ্ছে। এই মেলায় এখন পর্যন্ত কোন প্রকারের জুয়া থেকে শুরু করে অনৈতিক কোন কাজকে স্থান দেয়া হয়নি এবং যতদিন এই মেলা অনুষ্ঠিত হবে ততদিন ওই সকল অবৈধ আয়োজন মেলায় আসতে দেয়া হবে না।
মেলা কমিটির সভাপতি হাফিজুর রহমান বাচ্চু জানান, প্রায় শতাধিক বছর আগে বিলকৃষ্ণপুর গ্রামের মাঠে একটি গাড়ী (ছোট্ট পুকুর) ছিলো যার নাম “বয়লাগাড়ী”। ওই গাড়ীর পাশে একটি বটগাছ ছিলো। সেই বটগাছের নিচে পৌষ পার্বন উপলক্ষে পৌষ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে স্বল্প পরিসরে মেলা বসতো। দিন যতই যায় ততই মেলার পরিসর বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এক সময় আমাদের বাপ-দাদারা এই মেলা পরিচালনা করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় এখন আমরা হাল ধরে আছি। এক সময় চাহিদার ভিত্তিতে জায়গার স্বল্পতার কারণে বয়লাগাড়ীর পাশের এই বিলকৃষ্ণপুর মাঠের খোলা স্থানে মেলার আয়োজন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। দিন যতই যাচ্ছে ততই মেলার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অঞ্চলের মানুষরা প্রতি বছর এই মেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। এই মেলাকে ঘিরে প্রতিটি বাড়িতে মেয়ে-জামাইসহ নানা সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনদের আগমন ঘটে। উৎসবের আমেজে ভরে ওঠে চারপাশ।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তারিকুল ইসলাম বলেন, এই অঞ্চলের শতবছরের ঐতিহ্য হচ্ছে বয়লাগাড়ীর মেলা। মেলাটি যেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শেষ হয় সেই জন্য মেলা পরিচালনার জন্য স্থানীয় কমিটির পাশাপাশি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিলো। মেলা চলাকালীন সময়ে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। মেলার পরিবেশ উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ ছিলো।
এ জাতীয় আরো খবর..