নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন করে শুরু হয়েছে বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উজ্জীবিত দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন পর্যায়ে অভিজ্ঞ ও ত্যাগী নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। এরই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গতকাল শুক্রবার মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এবং অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনকে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া দ্রুততম সময়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির শূন্য পদ পূরণ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে। বিএনপির একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘দলের স্থায়ী কমিটিতে কিছু পদ শূন্য রয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় কাউন্সিলে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে দুই নেতাকে স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত করেছেন। হাইকমান্ড যখন উপযুক্ত মনে করবেন, তখন স্থায়ী কমিটি এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটির শূন্যপদগুলো পূরণ করবেন।’
বিএনপি নেতারা বলছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে এক বছরেরও বেশি রাজপথের আন্দোলনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে ওই সময় চূড়ান্তভাবে সফল হওয়া যায়নি। বিএনপিসহ অধিকাংশ দলকে বাইরে রেখেই গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হয়। জনগণ ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যান করলেও ভোটারবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ওই নির্বাচনের পর থেকেই সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করে বিএনপি। আন্দোলনে প্রত্যাশিত ভূমিকা না রাখায় বিএনপির চার মহানগর এবং ছাত্রদল ও যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। এ ছাড়া আন্দোলনে নিষ্ক্রিয়দের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাজপথে সক্রিয়দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় নিয়ে আসা হয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির বদলে দলের চেয়ারপারসনের ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি’ এবং ‘স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি’ নামে নতুন দুটি কমিটিও গঠন করা হয়। সিনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে একটি এবং তাদের সহায়তা করার জন্য আরেকটি কমিটি করা হয়। কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতেই এই দুটি কমিটি করা হয় বলে নেতারা জানিয়েছিলেন।
পরে যুবদল ও ছাত্রদলের পাশাপাশি চার মহানগর বিএনপিরও নতুন (আংশিক) কমিটি ঘোষণা করা হয়। নতুন নেতৃত্বে ওলামা দলের কমিটিও পুনর্গঠন করা হয়। ওই সময় বিএনপিতে তখন জোর আলোচনা ছিল, কয়েক ধাপে দলের নির্বাহী কমিটিতে দুই থেকে আড়াইশ পদে রদবদল আনা হতে পারে। তবে কোটা সংস্কার দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামার পর বিএনপি পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার চেয়ে ওই আন্দোলনকে বেশি গুরুত্ব দেয়। শুরু থেকেই দলটি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানায়। শুরুর দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিভিন্ন কর্মসূচিতে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের মধ্যে যারা নিয়মিত ছাত্র, তারা অংশগ্রহণ করেন। পরে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়লে বিএনপি ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও রাজপথে নামেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে দলকে চাঙ্গা ও ঐক্যবদ্ধ রাখতে ফের পুনর্গঠনে মনোযোগী হয়েছে বিএনপি।
জানা গেছে, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সব পর্যায়ে নেতৃত্বে পরিবর্তন আসবে। এ ক্ষেত্রে বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে যারা রাজপথে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন, তারা এগিয়ে থাকবেন। তবে বিভিন্ন সময়ে দলীয় নির্দেশনা অমান্য ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে যারা বহিষ্কার হয়েছেন, তাদের জন্য বিএনপির দরজা সহসাই খুলছে না।
জানা গেছে, বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল ও ছাত্রদল ছাড়া বাকিগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। শিগগির এসব সংগঠনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে। মহিলা দল, কৃষক দল ও স্বেচ্ছাসেবক দল দিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। যদিও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ এখনো এক বছরের মতো রয়েছে।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় যুবদল এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এসব কমিটি, বিএনপির নির্বাহী কমিটির শূন্যপদ এবং অন্য অঙ্গসংগঠনগুলোর শীর্ষ পদ পেতে ইতোমধ্যেই লবিং-তদবির শুরু করেছেন পদপ্রত্যাশীরা।
স্থায়ী কমিটিতে নতুন দুই মুখ:
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে নতুন দুজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এবং অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন। গতকাল শুক্রবার বিকেলে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
খালেদা জিয়ার সরকারের মন্ত্রী ছিলেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। ভোলা-৩ আসন থেকে তিনি একটানা ছয়বার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন এবং ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) মহাসচিব ছিলেন। বর্তমানে তিনি সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে যে বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ড রয়েছে, তারও অন্যতম সদস্য ডা. জাহিদ।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছরের আগস্টে ১৭ সদস্যের স্থায়ী কমিটি ঘোষণা করা হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে পদ রয়েছে ১৯টি। শুরু থেকেই দুটি পদ শূন্য ছিল। পরে এম কে আনোয়ার, তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ ও মওদুদ আহমদ মারা যান। আর সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান স্থায়ী কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। এতে শূন্য পদ দাঁড়ায় সাতে। পরে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে অন্তর্ভুক্ত করায় পাঁচটি পদ খালি থাকে। মেজর (অব.) হাফিজ ও ডা. জাহিদ যুক্ত হওয়ার পরও স্থায়ী কমিটিতে তিনটি পদ শূন্য রয়ে গেছে।
বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে আছেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া (পদাধিকারবলে), ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান (পদাধিকারবলে), ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জমির উদ্দিন সরকার, রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
এদিকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান বর্ষীয়ান নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান দীর্ঘদিন আলোচনায় থাকলেও পুনর্গঠনের এ ধাপেও স্থায়ী কমিটিতে জায়গা না পাওয়ায় তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
জানা গেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ, দলের ঐক্য ধরে রাখা, গণতন্ত্রের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখাসহ বহুমুখী কাজ বিবেচনায় বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের বাকি তিনটি শূন্য পদও দ্রুততম সময়ে পূরণ করা হবে। স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন—এমন কয়েকজন যোগ্য নেতার বিষয়ে দলের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। তারা হলেন সিনিয়র নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান, বরকতউল্লাহ বুলু, মো. শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আযম খান, অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন, নিতাই রায় চৌধুরী ও রুহুল কবির রিজভী। এ ছাড়া এর আগে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও জহির উদ্দিন স্বপনের নাম আলোচনায় থাকলেও গত জুনে তাদের বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করা হয়েছে।
এ জাতীয় আরো খবর..