সর্বশেষ ২০১৮ সালে জাকার্তা এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ হকি দল ষষ্ঠ হয়েছিল। এশীয় পর্যায়ে এটাই বাংলাদেশের হকিতে সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। অথচ আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চীনের হাংজুতে অনুষ্ঠেয় এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশকে চতুর্থ করতে চান বাংলাদেশ দলের দক্ষিণ কোরিয়ান কোচ ইয়ং কিউ কিম। সেই লক্ষ্য নিয়ে চলছে এক মাস ধরে তাঁর অনুশীলন ক্যাম্প। গতকাল সন্ধ্যায় মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে দোভাষীর মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে এই সাক্ষাৎকার।
বড় স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশ হকি দলের দক্ষিণ কোরিয়ান কোচ ইয়ং কিউ কিমশামসুল হক
প্রশ্ন: গত নভেম্বরে ঢাকায় ফ্র্যাঞ্চাইজি হকিতে একটি দলের কোচ হয়ে এসেছিলেন। এবার বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ। বাংলাদেশের হকি দলের প্রথম কোরিয়ান কোচ আপনি। তা এই এক মাস বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের কেমন দেখলেন?
ইয়ং কিউ কিম: সংকট-সম্ভাবনা সবই দেখছি। তবে অনেক কিছুতেই ঘাটতিটা বেশি চোখে পড়ে। আমি এসেই ফিটনেসের ওপর জোর দিই। কিন্তু ওরা সেই চাপটা নিতে পারেনি। খেলোয়াড়েরা একবারে ১০ বার পুরো মাঠ চক্কর দিতে পারে না। এটা কোরিয়ার হাইস্কুলের ছেলেও পারে (হাসি)।
প্রশ্ন: তাহলে তো বলতে হবে, এই খেলোয়াড়দের নিয়ে কঠিন একটা লড়াই-ই চলছে আপনার?
কিম: হ্যাঁ, আমি লড়াই করছি। আপনি দেখবেন, আমি কখনো তিন সহকারীর ওপর দায়িত্ব ছেড়ে বসে থাকি না। সারাক্ষণ ছেলেদের নিয়ে কাজ করতে থাকি। মাঠে বসে হাতে–কলমে দলীয় সমন্বয়, টেকনিক দেখাই। আমি নিজে কোরিয়া জাতীয় দলে সেন্টার ফরোয়ার্ড, লেফট উইং, রাইট উইং—তিন পজিশনেই খেলতাম। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দেরও তিন পজিশনে খেলাতে চাই। এগুলো নিয়ে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। ট্যাকটিক্যাল, টেকনিক্যাল ও ফিটনেসের উন্নতিতে কাজ করতে হচ্ছে বেশি।
কাল অনুশীলেন বাংলাদেশ হকি দলের কোচপ্রথম আলো
প্রশ্ন: বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মূল দুর্বলতা কোথায় দেখছেন?
কিম: কোনো কিছু শেখালে পরের ধাপটা কীভাবে শিখবে, সেটায় ঘাটতি আছে। হকি গোলের খেলা। বক্সে ঢুকে গোলের পজিশনটা তৈরি করতে পারে না বাংলাদেশের ছেলেরা। ফিটনেসে ঘাটতির কারণে চার কোয়ার্টারের পরের দুটিতে উদ্যম হারিয়ে গোল খায়। এসব বদলাতেই আমি কাজ করছি। কিছু উন্নতিও আছে।
প্রশ্ন: উন্নতি হলে গত মঙ্গলবার বিমানবাহিনীর কাছে আপনার দল অনুশীলন ম্যাচে ৩-২ গোলে হেরে গেল কেন?
কিম: বিমানবাহনীর সঙ্গে প্রতি–আক্রমণ চেয়েছি আমি। কিন্তু ছেলেরা তা পারেনি। ছেলেদের বলেছি, গোল খেতেই পারো, কিন্তু নিজের কাছে বল রেখে প্রতি–আক্রমণে যাও। এখন আমি চারটি জিনিসের ওপর জোর দিচ্ছি—বিল্ডআপ, টেকনিক, পজিশন ও পাসিং। সমস্যা হলো যে স্টাইলে আমি খেলাতে চাই, সেটা বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছে খেলোয়াড়দের।
প্রশ্ন: আপনার স্টাইলটা কী? কোরিয়ান?
কিম: হ্যাঁ। কোরিয়ানরা মাঠের অর্ধেক পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে খেলে দ্রুত আক্রমণে চলে যায়। ওদের রানিং খুব ভালো। একটা উদাহরণ দিই। ভারতের ভুবনেশ্বরে গত জানুয়ারিতে বিশ্বকাপ হকিতে আর্জেন্টিনার সঙ্গে ৩-২ গোলে পিছিয়ে ছিল কোরিয়া। ২৯ সেকেন্ড বাকি ছিল খেলা। রানিংয়ের কল্যাণেই কোরিয়া গোলটা শোধ করে কোয়ার্টার ফাইনালে যায়। বাংলাদেশকেও আমি এভাবে খেলাতে চাই। কিন্তু বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা সহজে তা পারছে না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা কি চাইলেই কোরিয়ানদের মতো খেলতে পারবে?
কিম: একেবারে যে কোরিয়ার স্টাইল হয়ে যাবে, তা নয়। বাংলাদেশের নিজস্ব স্টাইলও আছে। দুটোর সমন্বয় করে আমি চাইছি কোরিয়ান ধাঁচটা আনতে। বাংলাদেশ এশিয়ার শীর্ষ স্তরের দল নয়। এখন শীর্ষ পর্যায়ে যাওয়ার রাস্তাটা তৈরি করছি আমি। সব মিলিয়ে চাইছি ভালো একটা দল তৈরি করতে। এ জন্য ভালো কিছু প্র্যাকটিস ম্যাচ দরকার।
অনুশীলনে বাংলাদেশ হকি দলপ্রথম আলো
প্রশ্ন: ভালো প্র্যাকটিস ম্যাচ তো পাচ্ছেন না। এশিয়ান গেমসে তাহলে আপনার লক্ষ্য কী?
কিম: এশিয়াডে বাংলাদেশকে চতুর্থ করতে চাই। ৪ নম্বরে থাকতে পারলে অলিম্পিকের বাছাই খেলা যাবে। বাংলাদেশের জন্য এশিয়ান গেমসটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেটা মাথায় রেখেই হাংজু যাব।
প্রশ্ন: কিন্তু এশিয়াডে চতুর্থ হওয়া তো খাড়া পাহাড়ে ওঠার মতো ব্যাপার বাংলাদেশের জন্য। ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, জাপান, চীনের মতো দল আছে। চতুর্থ হওয়া আসলেই সম্ভব বলে বিশ্বাস করেন?
কিম: ভালো খেললে অসম্ভব নয়। আপনি বা বাংলাদেশের মানুষ হয়তো ভাবছে, চতুর্থ হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু খেলোয়াড়েরা জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত হয়ে চেষ্টা তো করতে পারে। আমি নিজেও সব অভিজ্ঞতা ঢেলে দিচ্ছি। জানেন তো, কোরিয়ানদের বাধ্যতামূলক আর্মি ট্রেনিং নিতে হয়। খেলোয়াড়ি জীবনে আমি সেটা নিয়েছিলাম ১৯৯২-৯৪ সালে। তাই মানসিকভাবে আমি খুব শক্ত এবং পরিশ্রমী। কোরিয়া দলের হয়ে এশিয়াডে দুবার সোনা জিতে আমি বুঝেছি, স্বপ্ন মানুষকে অনেক দূর এগিয়ে নেয়।
প্রশ্ন: এবার বলুন, আপনার দেশের হকি কেমন চলছে?
কিম: ভালো নয়। কারণ, সেভাবে খেলোয়াড় নেই। সব পুরোনো। কোরিয়ায় এখন সন্তান খুব কম নেয় দম্পতিরা। নিলেও একটা, ওকে খেলাধুলায় দেয় না। আমাদের সময় চার-পাঁচটা বাচ্চা হতো পরিবারে। একজন ডাক্তার, একজন প্রকৌশলী হতো, একজন হতো খেলোয়াড়। এখন বাচ্চাই হয় একটা, ফলে তাকে খেলায় দেয় না। তবে কোরিয়ান হকি ফেডারেশন চেষ্টা করছে খেলোয়াড় বাড়াতে।
এ জাতীয় আরো খবর..