কলাম লেখক: সাংবাদিক আসাদুল্লাহ গালিভ আল সাদি
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, রাসেল ভাইপার সাপ দেখার কারণে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলা জুড়ে আতঙ্কের ঢেউ বয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি, বিশেষ করে ফেসবুক, সাপের এই প্রজাতি সম্পর্কে ভয়ভীতি এবং ভুল তথ্যের প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এই হিস্টিরিয়া এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যে ফরিদপুরের একজন রাজনীতিবিদ প্রতিটি ভাইপারকে হত্যার জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা দিয়েছেন। কল্পকাহিনী থেকে সত্যকে আলাদা করতে এবং যুক্তিবাদী মানসিকতার সাথে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
রাসেলস ভাইপার (Daboia Russelii) একটি অত্যন্ত বিষাক্ত সাপ যা কামড়ালে মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। রাসেল ভাইপার ভারতীয় উপমহাদেশের ভিপেরিডি পরিবারের একটি অত্যন্ত বিষাক্ত সাপ এবং ভারতের সবচেয়ে ভয়ংকর চারটি সাপের মধ্যে একটি। এ প্রজাতি সাপের নামকরণ করা হয়েছে প্যাট্রিক রাসেলের নামে, একজন স্কটিশ হারপেটোলজিস্ট যিনি ১৭৯০ এর দশকে ভারতের অনেক সাপের বর্ণনা করেছিলেন। উলুবোড়া নামেও পরিচিত এই সাপ মূলত খোলা পরিবেশ যেমন কৃষি জমিতে বেশি বিচরণ করে যেখনে ইঁদুর শিকারে এর সুবিধা হয়।
রাসেল ভাইপারের দেহ মোটাসোটা, লেজ ছোট ও সরু। প্রাপ্তবয়স্ক সাপের দৈর্ঘ্য ১.৫-১.৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে ও এটিকে হালকা লালচে-বাদামী ও সাদাকালো দাগে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
যাইহোক, গ্রামাঞ্চলের মানুষকে যে ভয় গ্রাস করেছে তা মূলত অতিরঞ্জন এবং ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে। সাপ বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকরা জোর দিয়ে বলেন যে রাসেল ভাইপারের কামড় বিপজ্জনক হতে পারে, তবে অবিলম্বে চিকিৎসা করা হলে এটির কামড়ে মৃত্যু ঘটবেনা। তবে ওঝা-কবিরাজের পেছনে দৌড়িয়ে সময় নস্ট করলে মৃত্যু ঘটতে পারে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০২৩ সালে আনুমানিক ৪০০,০০০ সাপের কামড়ের প্রতিবেদন তৈরি করেছে। যার ফলে ৭,৫০০ জন মারা গেছে, প্রাথমিকভাবে কোবরা এবং পাতি কাল কেউটে (ক্রেইট) এর কামড়ের কারণে। যদিও রাসেল ভাইপারের কামড়ের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান অনুপলব্ধ, তবে এটি স্পষ্ট যে ভাইপারের এই প্রজাতিটি দেশে সাপের কামড়ে মৃত্যুর প্রধান কারণ নয়।
রাসেল ভাইপারের কামড় গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতার কারণ হতে পারে, তবে এই জটিলতাগুলি জীবন-হুমকিতে পরিণত হতে সাধারণত কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিন সময় লাগে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞসহ ডা. মোঃ আবুল ফয়েজ এবং অধ্যাপক ফরিদ আহসান জোর দিয়ে বলেন, যে সময়মত অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের ফলে মৃত্যুর ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেনের মতে আমাদের দেশে সাপের অ্যান্টিভেনম স্টক আছে যথেষ্ট, এবং হাসপাতালগুলি এই ধরনের জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত।
ভুল ধারণা এবং মিথ:
১. তাৎক্ষণিক মৃত্যু মিথ: জনপ্রিয় বিশ্বাসের বিপরীতে, রাসেলস ভাইপারের কামড় তাৎক্ষণিক মৃত্যুর কারণ হয় না। গবেষণা জানায় যে, রাসেল ভাইপার কামড় দিলেই রোগী মারা যায় এটিও সত্য নয়, বরং রোগী সহজে মারা যায় না। ন্যূনতম ৭২ ঘণ্টার আগে সহজে রোগী মারা যায় না। বাংলাদেশে এ সাপের কামড়ের পর ১৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলো এমন তথ্যও আছে।
২. দ্রুত প্রজনন এবং বিস্তার: যদিও রাসেল ভাইপার সাপটি একসঙ্গে ৩-৬৩টি পর্যন্ত বাচ্চার জন্ম দিয়ে থাকে। এসব বাচ্চা দুই বছরে পরিপক্ব হয়। এদের গর্ভধারণকাল ছয় মাস। এই সাপের কামড়ে দেড় বছরে শুধু রাজশাহী মেডিকেলেই মারা গেছেন অন্তত ১৮ জন। এ সময়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৮ জন। রাসেল ভাইপার নিশাচর এবং ঝোপ ও ফসলের ক্ষেতের মতো আবাসস্থল পছন্দ করে, মানুষের বাসস্থান নয়।
৩. কোন অ্যান্টিভেনম উপলব্ধতা নেই দাবী: এটি একটি মিথ্যা দাবি। পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম, রাসেলের ভাইপার বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর, এবং বাংলাদেশে পাওয়া যায়। আসল সমস্যাটি গ্রামীণ এলাকায় প্রশিক্ষিত চিকিৎসক এবং আইসিইউ সুবিধা নেই।
পরিবেশগত ভূমিকা এবং সংরক্ষণ:
রাসেল ভাইপার ইঁদুরের বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা ফসল উৎপাদনের জন্য উপকারী হতে পারে। তারা বাস্তুতন্ত্রের অংশ, এবং নির্বিচারে হত্যা অভিযান এই ভারসাম্যকে ব্যাহত করতে পারে, যার ফলে অনিচ্ছাকৃত একটি ভয়ানক পরিণতি হতে পারে।
রাসেলে ভাইপার পাওয়া গিয়েছে অথবা সাম্প্রতিক সময় দেখা গেছে এমন এলাকায় বসবাসকারী লোকেরা সাপের কামড় এড়াতে কিছু ব্যবহারিক পদক্ষেপ নিতে পারে:
- মাঠে কাজ করার সময় প্রতিরক্ষামূলক জুতা (রাবারের রেইন বুট) এবং পোশাক পরুন।
- সাপ লুকিয়ে থাকতে পারে এমন জায়গাগুলিতে কাজ করার সময় লাঠি সাথে রাখুন।
- মানুষের আবাসস্থলে আশ্রয় খোঁজা থেকে সাপকে আটকাতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখুন।
দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের দ্বারা শিয়াল, মনিটর লিজার্ড ও বেজিদের মতো প্রাকৃতিক শিকারী হত্যা পরিবেশগত ভারসাম্যকে ক্ষতি করেছে, যার ফলে দেশে সাপের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সব প্রাকৃতিক শিকারীরা সাপের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল, ফলে এদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মানুষ-সাপের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা বেশি করে ঘটছে।
ভুল তথ্য ও আতঙ্ক মোকাবেলায় বন কর্মকর্তা মো. মোতালিব আল মমিন এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা সক্রিয়ভাবে সঠিক তথ্য প্রচার করছেন। সরকার উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আরও কার্যকরভাবে অ্যান্টিভেনম বিতরণের কাজ করছে।
এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, সারা দেশে অ্যান্টিভেনমের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশে রাসেল ভাইপারকে ঘিরে থাকা ভয় তাদের প্রকৃত হুমকির তুলনায় অনেকাংশে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সঠিক তথ্য ছড়িয়ে এবং ব্যবহারিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রচার করে, আমরা আতঙ্ক প্রশমিত করতে পারি এবং নিশ্চিত করতে পারি যে মানুষ এবং সাপ উভয়ই শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে। ভয়ে এসব সাপ মেরে ফেলা কোনো সমাধান নয়। পরিবর্তে, শিক্ষা এবং সচেতনতা এই সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি।
দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে, নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য খোঁজা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অযাচাইকৃত দাবি ছড়ানো থেকে বিরত থাকা আমাদের কর্তব্য। আসুন আমরা আমাদের সম্প্রদায়ের রাসেল ভাইপার এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীর থেকে উৎপন্ন বিপদ মোকাবিলা করার জন্য আরও সচেতন এবং যুক্তিযুক্ত পদ্ধতির বিকাশের জন্য একসাথে কাজ করি।
এ জাতীয় আরো খবর..