হাইকোর্ট বলেছেন, ‘একটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কত অর্থ প্রয়োজন? কত অট্টালিকা দরকার? এত টাকার পেছনে কেন ঘুরবে? আমরা যদি সবকিছু দেখে চোখ বন্ধ করে থাকি, সেটা কাম্য নয়। কারণ, কথা না বলাটা অপরাধ।’
রুল বিচারাধীন অবস্থায় দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ-সম্পর্কিত বিষয়ে আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের পক্ষভুক্তির আবেদনের শুনানিকালে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে ‘এস আলম’স আলাদিন’স ল্যাম্প’ (এস আলমের আলাদিনের চেরাগ) শিরোনামে ৪ আগস্ট একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি নজরে আনার পর শুনানি নিয়ে ৬ আগস্ট হাইকোর্টের একই বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ অভিযোগ অনুসন্ধান করতে নির্দেশ দেন।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে অর্থ পাচার (মানি লন্ডারিং) রোধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা বা ব্যর্থতা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত হবে না, তা রুলে জানতে চাওয়া হয়। ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রতিবেদনটি আদালতের নজরে আনা আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন আজ হাইকোর্টে এক লিখিত আবেদন দিয়ে বলেন, তিনি এস আলম সম্পর্কিত বিষয়ে পক্ষভুক্তি হতে চান। তবে সায়েদুল হকের এই আবেদনের তীব্র বিরোধিতা করেন এস আলম গ্রুপের আইনজীবী আহসানুল করিম এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুদ্দিন খালেদ।
আইনজীবী আহসানুল করিম এ বিষয়ে আদালতকে বলেন, কী উদ্দেশ্যে তিনি এই মামলায় পক্ষ হতে চান? এই মামলায় আদালতকে সহযোগিতা করতে পারেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সায়েদুল হক তো জনস্বার্থে (পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন) এটা করেননি। তিনি তো শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে এনেছেন। তিনি কোনোভাবেই এই মামলায় পক্ষভুক্ত হতে পারেন না। আদালতে একই যুক্তি তুলে ধরেন সাইফুদ্দিন খালেদ।
শুনানির একপর্যায়ে আদালত আইনজীবী আহসানুল করিমের কাছে জানতে চান, ‘সায়েদুল হক পক্ষভুক্ত হলে সমস্যা কোথায়?’
তখন আহসানুল করিম আদালতকে বলেন, রুলের বিচারাধীন অবস্থায় এস আলম গ্রুপ-সম্পর্কিত বিষয়ে বিভ্রান্তিকার তথ্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জনমনে ভ্রান্ত ধারণা ও আতঙ্ক তৈরি হয়। তাতে প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘কথা না বলাটা অপরাধ। সবাই যদি চুপ করে থাকি তাহলে তো হবে না। জেনেশুনে চুপ থাকা যাবে না।’
তখন আইনজীবী আহসানুল করিম আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা তো দেখবেনই।’ আদালত তখন বলেন, ‘এখন তো আগের যুগ নেই। একটা কথা বললে সঙ্গে সঙ্গে তা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। দেশ ও জাতির স্বার্থে আমরা মনে করি, আমাদের দায়বদ্ধতার ব্যাপার রয়েছে। যদি আমরা সবকিছু দেখে চোখ বন্ধ করে থাকি, সেটা কাম্য নয়। এটা অন্যায়।’
হাইকোর্ট আরও বলেন, ‘যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বা কাউকে হিউমিলিয়েট (হেয়প্রতিপন্ন) করার জন্য কোনো ভুল রিপোর্টিং হয়, যদি দেখা যায় ভুল রিপোর্ট হয়েছে, আমরা কাউকে ছাড়ার পাত্র নই।’
তখন আইনজীবী আহসানুল করিম আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা সবার মঙ্গলের জন্যই করেন।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুর্নীতিবিরোধী বক্তব্য তুলে ধরে তা স্কুল–কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। আদালত আরও বলেন, ‘আমরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যদি বিচার করতে পারতাম; আমরা যা বলি তা করি কি না? মানুষের সামনে যা বলি, তা ঘরে করি কি না? যদি করতাম, তাহলে কি দেশের এই অবস্থা হয়? কত অট্টালিকা দরকার? কে কী মনে করল, সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। শপথ নিয়ে লাভটা কী?’
এ পর্যায় আইনজীবী আহসানুল করিম আদালতকে বলেন, ‘আপনাদের (বিচারপতি) এ ধরনের বক্তব্যে মানুষ উজ্জীবিত হয়।’ তখন আদালত বলেন, ‘একটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কত অর্থের প্রয়োজন? এত টাকার পেছনে ঘুরতে হবে কেন?’
আদালত আরও বলেন, রায় পক্ষে গেলে হেসে দেন। বিপক্ষে গেলে ফরমায়েশি রায় বলে সমালোচনা হয়। ফরমায়েশি রায়ের কথা শুনলে বিব্রত হন বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।
শুনানির শেষ পর্যায়ে আইনজীবী সায়েদুল হক আদালতকে বলেন, ভারতের আদানি গোষ্ঠী নিয়ে গণমাধ্যমের সংবাদ প্রকাশের নিষেধাজ্ঞা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে যে আবেদন করা হয়েছিল, সেটি খারিজ করে দিয়েছিলেন ভারতের প্রধান বিচারপতি। এ–সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তিনি আদালতের নজরে আনেন।
এ পর্যায় হাইকোর্ট সায়েদুল হকের উদ্দেশে বলেন, ‘পক্ষভুক্তি হওয়ার যে আবেদন, সেটি আমরা খারিজ করছি না। আপনার আবেদন নথিতে সংযুক্ত থাকবে। প্রয়োজন হলে আমরা আপনাকে ডাকব।’
এদিকে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে ‘এস আলম’স আলাদিন’স ল্যাম্প’ (এস আলমের আলাদিনের চেরাগ) শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রুলসহ অভিযোগ অনুসন্ধানের আদেশ স্থগিত চেয়ে চেম্বার বিচারপতির কাছে আবেদন করেছে এস আলম গ্রুপ। শুনানির জন্য দুদকের পক্ষে থেকে চেম্বার বিচারপতির কাছে সময় চাওয়া হয়। দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, আগামী বুধবার শুনানির দিন ধার্য করেছেন চেম্বার বিচারপতি।
এ জাতীয় আরো খবর..