সত্তরোর্ধ্ব অনিতা মণ্ডলের জ্বর আসে আরও পাঁচ দিন আগে। পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এরপর নিজ এলাকা গোপালগঞ্জেই চিকিৎসা নেওয়া শুরু করেন। পরে শরীর আরও খারাপ করলে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। কিন্তু উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকেরা তাঁকে ঢাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেন।
আজ শুক্রবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের সপ্তম তলায় (মেডিসিন বিভাগ) ওঠার দুই সিঁড়ির মাঝে ঠাঁই পেয়েছেন অনিতা মণ্ডল। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে তিনি ভর্তি হয়েছেন। অনিতা মণ্ডলের মেয়ে আরতি মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মায়ের শরীর শুরুতে ভালোই ছিল। কিন্তু জ্বর হওয়ার দুই দিন পর দাঁত দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়। ফরিদপুরে নিয়েও তা বন্ধ করা যায়নি। পরে তাঁরা ঢাকা মেডিকেলে চলে আসেন। এখানে চিকিৎসা চলছে এবং অনিতা মণ্ডলের রক্তপাতও বন্ধ হয়েছে।
ঢাকার বাইরে থেকে আসা আরও কিছু রোগী দেখা গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তাঁদের অনেকেই নিজ এলাকার চিকিৎসকদের পরামর্শে ঢাকায় এসেছেন।
গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারে কাজ করেন আবু বকর। সপ্তাহখানেক আগে তাঁর জ্বর এলে কিশোরগঞ্জে নিজ বাড়িতে চলে যান। সেখানে ডেঙ্গু ধরা পড়লে তিনি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু তাঁর প্লাটিলেটের মাত্রা কমতে কমতে ১১ হাজারে নেমে যায়। চিকিৎসকেরা তাঁকে ঢাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেন।
আবু বকরকে পাওয়া যায় ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের সপ্তম তলার ওয়ার্ডের বাইরে মেঝেতে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন তাঁর শরীর ভালো। দু–এক দিনের মধ্যেই হয়তো হাসপাতাল ছাড়তে পারবেন।
গোপালগঞ্জের শহীদ শেখরেরও প্লাটিলেট অনেক কমে গিয়েছিল। সেখানকার চিকিৎসকেরা তাঁকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। তিনিও ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সিরাজগঞ্জের মোহাম্মদ মানিক এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় এসেছেন কাজের জন্য। এসেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তিন দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। হাসপাতালের ষষ্ঠ তলায় শুয়ে ছিলেন মানিক। তাঁর মা ময়না খাতুন বলেন, মানিক উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনা করছিলেন। কিন্তু মাঝে পড়া ছেড়ে দিয়ে কাজ করবেন বলে ঢাকায় চলে আসেন। এসেই তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হন।
হাসপাতালের সপ্তম তলায় রোগীদের চাপ সবচেয়ে বেশি। কোথাও একই স্ট্যান্ডের সঙ্গে দুজনের স্যালাইন ঝুলছে। কোথাও জানালার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে, আবার সিঁড়ির রেলিংয়ে বেঁধেও স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেলের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম তলা নিয়ে মেডিসিন বিভাগ। এই বিভাগে পা ফেলার জায়গা নেই বললেই চলে। দুই সিঁড়ির মাঝে যে ফাঁকা জায়গাটুকু রয়েছে, সেখানেও দু–তিনজন করে রোগী। তাঁদের একজন মোশাররফ হোসেন। মশারি টানিয়ে শুয়ে আছেন। মহাখালী থেকে গতকাল রাতে এসে তিনি এখানে ভর্তি হয়েছেন। পাশে থাকা তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমবার পরীক্ষায় তাঁর স্বামীর ডেঙ্গু ধরা পড়েনি। চিকিৎসক ভর্তি নিয়ে আবার পরীক্ষা দিয়েছেন। কারণ, জ্বর কমছে না এবং সব লক্ষণই রয়েছে।
হাসপাতালের সপ্তম তলায় রোগীদের চাপ সবচেয়ে বেশি। কোথাও একই স্ট্যান্ডের সঙ্গে দুজনের স্যালাইন ঝুলছে। কোথাও জানালার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে, আবার সিঁড়ির রেলিংয়ে বেঁধেও স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার একটি ওয়ার্ডের ভেতর দেখা যায়, নার্সদের বসার জায়গা ঘিরে রোগী ও স্বজনের ভিড়। সেখানে দাঁড়ানোরও সুযোগ নেই। কারও স্যালাইন লাগানো, কারও পরীক্ষা, কারও–বা কোনো তথ্য জানার প্রয়োজন। কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা ভিড়ের মধ্যেই রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন।
ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে আপনি কতটা সচেতন?
ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগেই ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে। সেখানে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা কোনো ইউনিট চোখে পড়েনি। পাশাপাশি শয্যায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও চিকিৎসা নিচ্ছেন। এতে অন্য রোগীরাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে অনেক রোগীর স্বজনেরা অভিযোগ করেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে মুগদা হাসপাতালের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এখান থেকে রোগী ফিরিয়ে দেওয়া হয় না, এমন বিশ্বাস নিয়েই রোগীরা এখানে আসেন। আর হাসপাতালটির রোগী ধারণক্ষমতাও বেশি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক আজ প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল পর্যন্ত তাঁদের হাসপাতালে ৩৫১ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। চলতি বছর এ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে মারা যান ৪৫ জন।
ডেঙ্গু রোগীর সঙ্গে অন্য রোগীদের রাখার বিষয়ে তিনি জানান, কিছু ওয়ার্ডে আলাদা করা আছে। এ ছাড়া জরুরি বিভাগের আন্ডারগ্রাউন্ডে ডেঙ্গুর জন্য ইউনিট চালুর প্রস্তুতি চলছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে রোগী আসা প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক বলেন, ক্রিটিক্যাল রোগী হলেই তাঁরা ঢাকায় আসছেন।
এ জাতীয় আরো খবর..