যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ নিয়ে পাল্টাপাল্টি প্রশ্ন করেছেন দুজন বাংলাদেশি সাংবাদিক। একজন বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতের জন্য আওয়ামী লীগ ও পুলিশ বাহিনীকে দায়ী করে প্রশ্ন করেন। অন্যজন বিএনপির বিরুদ্ধে অগ্নিসন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে প্রশ্ন ছোড়েন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ব্রিফিংয়ের বিবরণী ও ভিডিও থেকে জানা যায়, দেশে সংঘাতের জন্য আওয়ামী লীগ ও পুলিশকে দায়ী করে প্রশ্ন করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সেক্রেটারি ও অনলাইন নিউজপোর্টাল জাস্ট নিউজের সম্পাদক মুশফিকুল ফজল আনসারী।
তিনি ওয়াশিংটনে সাউথ এশিয়া পার্সপেক্টিভ নামের একটি মাসিক প্রকাশনার নির্বাহী সম্পাদক এবং রাইট টু ফ্রিডম নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক।
পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মুশফিকুল ফজল আনসারী বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে কয়েক মিলিয়ন মানুষ রাজধানী ঢাকায় সমবেত হয়েছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত শনিবার পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ওপর বর্বর হামলা চালান। এতে বিরোধী শীর্ষ নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ কয়েক শ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।
বিরোধী দলের প্রতি সরকারের দৃশ্যত কঠোর অবস্থান এবং পুলিশের বর্বরতা ক্রমেই উত্তপ্ত, এই পরিস্থিতিকে আপনারা কিভাবে দেখছেন? বাংলাদেশে বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর কী কী পদক্ষেপ নেবে?’
জবাবে মুখপাত্র মিলার বলেন, ‘গত সপ্তাহান্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিক্ষোভকে ঘিরে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সহিংসতার ঘটনাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং সহিংস অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানাই।’
পররাষ্ট্র দপ্তরের এই মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করার এবং নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরির তাগিদ দেওয়াসহ সব দলকে মৌলিক স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের প্রতি সম্মান বজায় রেখে সহিংসতা, হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই।’ তিনি বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ভোটার, রাজনৈতিক দল ও তাদের যুব শাখা এবং পুলিশ—সবার অঙ্গীকারের ওপর নির্ভর করে।
সেটি রাজনৈতিক সহিংসতার পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতে পারে না।
এরপর সময় টেলিভিশনের সাংবাদিক দস্তগীর জাহাঙ্গীর প্রশ্ন করেন, ‘আমরা সবাই জানি যে বাংলাদেশ একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল গত সপ্তাহের মতো দেশের রাজধানীতে অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাস ও ভাঙচুর চালাচ্ছে।
তারা শুধু বেসামরিক সম্পত্তি নয়, পুলিশের সম্পত্তিতেও আক্রমণ করছে। সেখানে তারা সব কিছু পুড়িয়ে দিয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে তারা রাজধানীতে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্বাচনকালীন (তত্ত্বাবধায়ক) সরকারকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?’ জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেন, ‘আগের প্রশ্নে আমি যে উত্তর দিয়েছি, এই প্রশ্নেও আমার একই মন্তব্য।’
এরপর দস্তগীর জাহাঙ্গীর পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘গত ১৫ জুন কানাডার একটি ফেডারেল আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কানাডায় একজন বিএনপিকর্মীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হয়েছিল। এ নিয়ে পঞ্চমবারের মতো দলটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দিল কানাডা। সে বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? জবাবে ম্যাথু মিলার বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো পর্যবেক্ষণ নেই।’
জাতিসংঘের ব্রিফিংয়েও প্রশ্ন
গত সোমবার রাতে জাতিসংঘ মহাসচিবের উপমুখপাত্র ফারহান হকের ব্রিফিংয়ের প্রশ্নোত্তর পর্বে বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিশেষ প্রতিনিধি লাভলু আনসার প্রশ্ন করতে গিয়ে বলেন, ‘১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তা সত্ত্বেও সুধীসমাজের কিছু ব্যক্তি এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা কিছু সংগঠন, এমনকি মার্কিন কংগ্রেসের কিছু সদস্য জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ থেকে বাংলাদেশকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন। আপনি কি এই ধরনের দাবি সম্পর্কে অবহিত?’
লাভলু আনসার আরো যোগ করেন, ‘কথিত সুধীসমাজ এবং আমেরিকা থেকে নির্বাচিত কিছু ব্যক্তিও বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সে লক্ষ্যে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো অবাধে সভা-সমাবেশ করছে। এ অবস্থায় জাতিসংঘের অবস্থান কী?’
জাতিসংঘ মহাসচিবের উপমুখপাত্র বলেন, ‘প্রথমত, জাতিসংঘ বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনকে উৎসাহিত করে। জাতিসংঘ প্রকৃত অর্থেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের উদারতার প্রশংসা করে। আমরা আশা করি, এটি অব্যাহত থাকবে। মানবাধিকার পরিষদের সদস্য পদ নিয়ে মন্তব্য করা আমার কাজ নয়। এ বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলো সিদ্ধান্ত নেয়।’
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞের টুইট বার্তা
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিরোধী মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন সভা-সমাবেশের অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ক্লেমো ভউল। গত মঙ্গলবার রাতে এক টুইট বার্তায় ক্লেমো ভউল লিখেছেন, ‘চলমান বিক্ষোভ সমাবেশে সংঘাত ও গ্রেপ্তারের মাত্রা বাড়ছে, এ অবস্থায় সব পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
ক্লেমো ভউল আরো লিখেছেন, ‘দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোকে বলব, তারা যেন সভা-সমাবেশের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করে এবং বাড়তি বল প্রয়োগ না করে।’
এ জাতীয় আরো খবর..