সম্প্রতি ৪১ বিসিএসের ফল প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে পুলিশ ক্যাডারে ৯ম হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হক। বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার সময় তার বাবা দুর্ঘটনায় পড়ে আইসিইউয়ে ভর্তি হন। পর দিন মারা যান। বাবাকে দাফন করে আবার পরের দিন পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল মাহমুদুলকে। যুগান্তরের বিশেষ সাক্ষাৎকারে তার জীবনের চড়াই-উতরাই নিয়ে কথা বলেছেন।
এসময় তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, পড়ালেখায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কিনা? প্রশ্নোত্তরে মাহমুদুল বলেন, হাজারও কষ্ট করে হলেও পড়াশোনার জন্য কোনো অভাব বুঝতে দেয়নি বাবা-মা। আমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে। আমি বলতে পারি— পরিবারের অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব সবটুকু দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে।
বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো সাবজেক্ট পেলেও আমার আব্বার ইচ্ছায় শুধু রাজনীতি করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমার আব্বুর ইচ্ছা ছিল— ভালো প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতিতে যেন নেতৃত্ব দিই আমি। এ জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ে ভর্তি হওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ভর্তির পর পরই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়ি।
হল ও কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বেও ছিলাম। কোভিডকালীন সবকিছু যখন স্তিমিত হয়ে গেল, তখন আব্বু বলল— সিভিল সার্ভিসে চেষ্টা কর। ওই সময় বিসিএসের জন্য পড়া শুরু করি। আগেই ৪১তম বিসিএসে আবেদন করা ছিল। পরে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা দিই।
৪১তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা কেমন হয়েছিল?
রিটেন পরীক্ষার সময় আমার জীবনে একটা ট্র্যাজেডি এসেছিল। ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর আমাদের বিসিএস লিখিত ইংরেজি পরীক্ষা হয়েছিল। ভালো পরীক্ষা দিয়ে খুশি মনে আব্বু-আম্মুকে কল করেছিলাম। আম্মুকে পেলেও বাবা ফোন রিসিভ করতে পারেনি। তবে এ সুখবরটি আম্মুর মাধ্যমে জানতে পারে আব্বু। পরে বাসায় ফেরার পথে আব্বু বাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। পরীক্ষার কারণে আমাকে জানানো হয়নি। পরে স্থানীয় বন্ধু ও আত্মীয়দের মাধ্যমে জানতে পারি।
বাসায় ফোনে জানতে চাইলে আম্মু বলে, আব্বু বাইক থেকে পড়ে গিয়ে সামান্য আঘাত পেয়েছে। অথচ আব্বু ততঃক্ষণে দুই হাসপাতাল ঘুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। এদিন রাত ৯টায় জানতে পারি আব্বুর অ্যাক্সিডেন্টে ব্রেইন হ্যামারেজ হয়েছে। বেশিক্ষণ বাঁচবেন না।
বাবা লাইফসাপোর্টে, পরীক্ষার সময় নিজেকে কীভাবে স্থির রেখেছিলেন?
রাত ৩টায় আব্বুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। আমি আব্বুর পাশে ছুটে যেতে চেয়েছিলাম। পর দিন পরীক্ষা থাকায় কেউ আমাকে হাসপাতালে যেতে দেয়নি। পর দিন পরীক্ষায় বসলাম অন্যদিকে বাবা হাসপাতালে লাইফসাপোর্টে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। পরীক্ষা শেষে হাসপাতালে পৌছে জানতে পারি— আব্বুর অবস্থা এতটাই রিস্কি যে, অপারেশন করার কোনো সুযোগ নেই।
আব্বুকে আইসিইউতে লাইফসাপোর্টে রেখে অনেক চেষ্টা করেছি অপারেশন করার জন্য। কিন্তু ডাক্তাররা রাজি হননি অপারেশন করতে। সারারাত হাসপাতালে থেকে পর দিন সকালেও বাংলা পরীক্ষা দিই। লাইফসাপোর্টের ঘুম থেকে চিরদিনের ঘুমে চলে গেল আব্বু।
পরীক্ষা শেষ করে আব্বুর লাশ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। বাসায় পৌঁছে বাবাকে কবরে দাফন করে আবার ঢাকায় চলে এলাম। পর দিন গণিত পরীক্ষায় বসলাম।
বাবাকে দাফন করায় মানসিকভাবে কেমন ছিলেন?
আসলে আব্বু দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিসিএসের প্রতি আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম। কখনই আমি বই নিয়ে টেবিলে বসেছি বলে মনে পড়ে না। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করার পর ও ভাইভার কোনো প্রস্তুতি নিইনি। ভেবেছিলাম ভাইভাতেও অংশগ্রহণ করব না। আব্বু যেহেতু নেই, তা হলে বিসিএস ক্যাডার হয়ে কি হবে? আব্বুকে কবরে রেখে আসার পর প্রস্তুতি ছাড়াই বাকি পরীক্ষাগুলো দিয়েছি।
এখনো আমার কানে বাজে, বাবা সবসময় বলতেন— আমার ছেলে বড় নেতা হবে, পুলিশের এএসপি হবে। উনি আমায় নেতার আসনে দেখে গেছেন, পুলিশের এএসপি হিসেবে দেখা হলো না বাবার।
এখনো আমাকে খুব পীড়া দেয় যে, মৃত্যুশয্যায় রেখে আমি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পরীক্ষার জন্য শেষবারের মতো কথা বলার সুযোগ হয়নি বাবার সঙ্গে।
কর্মজীবনে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
নিজের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে পুলিশ বাহিনীতে নিজেকে সর্বোচ্চ স্থানে দেখতে চাই।
এ জাতীয় আরো খবর..