এমরান মাহমুদ প্রত্যয়,আত্রাই(নওগাঁ):
আদিম যুগ থেকে মানুষ যখন সভ্যতার যুগে আসা শুরু করলো, বিজ্ঞানের যুগে প্রবেশ করার সাথে সাথেই মানুষের মাথায় চিন্তা আসলো, দোয়াত-কলমের লেখাটা কিভাবে মেশিনের মাধ্যমে টাইপ আকারে করা যায়। সেই চিন্তা থেকেই মানুষ টাইপিং মেশিন আবিস্কার করল, আমি আপনাদের যে টাইপিং মেশিনটি নিয়ে লিখছি তা এখন শুধু স্মৃতি প্রায়। টাইপ রাইটার। যা এখন কোথাও দেখা যায় না। হয়তোবা কয়েকটি দপ্তরের সংরক্ষণ শালায় সংরক্ষিত রয়েছে এই টাইপ রাইটার।
সময়ের পরিবর্তনে কত কিছুই না হারিয়ে যায়। ডিজিটাল দুনিয়ায় আজ অ্যানালগ প্রায় অচল। তেমনি প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় হারিয়ে যাচ্ছে টাইপরাইটার পেশা।সময়ের সাথে আধুনিকতার ছোঁয়ায় কম্পিউটারের আগমনে এক সময়ের জনপ্রিয় টাইপরাইটার’ অ অ ক খ প্রিন্ট এখন বিলুপ্তির পথে। টাইপরাইটারের খটখট শব্দ আর তেমন শোনা ও দেখা যায় না কোথাও। টাইপরাইটারের সঙ্গে যাদের জীবন-জীবিকা বাঁধা ছিল সেই মুদ্রাক্ষরিকরাও (টাইপিস্ট) এখন হারিয়ে যাচ্ছেন সময়ের পরিক্রমায়। অনেকেই পেশা বদলাচ্ছেন। অনেকে বেকার হয়েছেন। আবার অনেকে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলেও এখনো সেই টাইপ মেশিনকে আঁকড়ে ধরেই জীবন সংগ্রাম করছে প্রতিদিন। এক সময় অফিস-আদালতে সাঁটলিপিকার ও মুদ্রাক্ষরিক পদটি ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে শব্দের গতি গুনে চাকরি মিলত। মিনিটে ৬০ শব্দ নিখুঁতভাবে টাইপ করতে পারেন এমন দক্ষ টাইপিস্টের কদর ছিল বেশি। সেই পদটিও এখন বিলুপ্তির পথে। সরকারি-বেসরকারি অফিসে এই যন্ত্রটি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অফিস-আদালত টাইপরাইটারের পরিবর্তে কম্পিউটার কিনছে। কম্পিউটারের লেখায় কোনো কাটাকাটি নেই, ভুল হলেই অটো সংশোধন। এক সময় আদালত প্রাঙ্গণ, ভূমি অফিস, নগর ভবন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিস সংলগ্ন কোনো গাছের নিচে সারিবদ্ধ হয়ে কাজ করতেন টাইপিস্টরা। এখন কোথাও তরুণ টাইপিস্ট খুঁজে পাওয়া যায় না। আগের তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম হলেও মাঝ বয়সী ও বয়স্ক টাইপিস্টদেরই মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে।
রবিবার সকালে নওগাঁ জজ কোর্ট চত্বরে গিয়ে দেখা যায়,আগের দিনের মত বাহিরে সারিবদ্ধ হয়ে বসে কেউ আর টাইপ করে না শোনা যায় না টাইপের খটাখট শব্দ।
এরইমধ্যে দেখা হয় মধ্যবয়সী টাইপিস্ট কাজের ফাঁকে কথা হয় টাইপিস্ট শহিদুল ইসলামের সাথে।
মো.শহিদুল ইসলাম জানান, ‘তিনি ৩০ বছর ধরে এই পেশায় রয়েছেন। নওগাঁ আইনজীবি সমিতির ভবন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগেও তিনি নওগাঁ জজ কোর্ট চত্বরে টাইপরাইটিং-এর কাজ করতেন। টাইপরাইটিং পেশায় বেশ কয়েক জায়গায় চাকুরী পেয়েও তিনি অন্য কোন স্থানে চাকুরী না তিনি নিজের প্রানের শহর নওগাঁতেই থেকে টাইপরাইটিং পেশায় এখনো রয়েছেন।’ তিনি আরো বলেন,আমার বাবাও টাইপরাইটিংয়ের কাজ করেই তার মৃত্যু হয়। শুধু শহিদুল ইসলাম ই নয় তাঁর সাথে আরো বেশ ক হন টাইপার ছিল। তারও জীবনের অর্ধেক বয়স এই পেশায় দিয়েছে। বয়স্ক হয়েও এখন সংসারের টানে করছে টাইপরাইটিং’র কাজ। তারা জানান, ‘এক সময়ে এই পেশায় তাদের ভাল উপার্জন হলেও বর্তমানে কম্পিউটারে অধিকাংশ কাজ হওয়ায় তাদের উপার্জন কমে গেছে। প্রতিদিন ২শ’ থেকে আড়াইশো টাকা হলেও মাঝে মধ্যে আয় রোজগার হয়ই না।’ তার মধ্যে আবার বন্ধ শুক্র-শনিবার। একই কথা জানান শহিদুল ইসলাম। তিনি আরো বলেন, ‘সারাদিন বসে থেকে দুই তিনটা কাজ পায় । আবার কোন দিন একটিও পায় না। টাইপ মেশিনের খটখট শব্দ কমে যাওয়ার সাথে সাথে কমে যাচ্ছে তাদের আয় রোজগারও। এই কম্পিউটার যুগে মানুষ আর টাইপিস্টদের কাছে যেতে চায় না। একদিকে কম্পিউটার, অপরদিকে ফটোকপি মেশিন। এই দুই মেশিন এসে টাইপিস্টদের পথে বসিয়েছে। তাদের দিন চলছে অর্ধাহারে অনাহারে। সংসার নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তারা। তবে অনেকের আবার ছেলে মেয়ে সুশিক্ষিত হয়ে ভাল চাকরি ও প্রবাসে থাকায় তাদের সংসার খরচ এখন আর চিন্তা করতে হয় না।’ তারা বলেন, ‘দশ আঙ্গুলের কারুকর্মের ধরন পরিবর্তন না হলেও যন্ত্রটির পরিবর্তন হয়েছে। হারিয়ে যাচ্ছে টাইপরাইটার। এখন চলছে কি বোর্ড বা কি প্যাডের কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব আর স্মার্টফোনের দিন।’ শহিদুল ইসলাম আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘প্রযুক্তির আধিপত্যে একদিন হয়তো জাদুঘর আর ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেবে এককালের জনপ্রিয় এই টাইপরাইটার মেশিন।’
টাইপিস্ট ও টাইপরাইটার মেশিন সম্পর্কে তরুণ এ্যাপ্রেন্টিস লয়ার
সাদেকুর রহমান বাঁধন বলেন,আমি যখন খুব ছোট তখন বাবার সাথে কোর্ট জেলখানা ও বেশ কিছু অফিস ঘুরে দেখতে এসেছিলাম তখন দেখেছিলাম সারিবদ্ধ ভাবে বসে খটাখট শব্দে কাজ করছে। জানতাম না এ মেশিন দিয়ে কি কাজ হয়।শুধু খটখট শব্দ মুখরিত ছিল কোর্ট আঙিনা। কালের আবর্তে এখন আর সে ভাবে টাইপরাইটার মেশিনের কদর নেই যে দু এক জনকে এ পেশায় দেখা যায় হয়তো তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেখাতে চায় যুগের আধুনিকতায় নিভু নিভু করে টিকে আছে দু একজন টাইপিস্ট ও টাইপরাইটার মেশিন নিয়ে।
এ জাতীয় আরো খবর..