আয়কর আইনে পরিবর্তন আনায় কর দিবসের (৩০ নভেম্বর) পর রিটার্ন জমা দিলে করদাতাদের ওপর জরিমানা-করের খড়্গ নামবে। বিলম্ব সুদ, জরিমানার পাশাপাশি কর নির্ধারণের হিসাব-নিকাশ পালটে যাবে। এতে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের মোটা অঙ্কের বাড়তি কর দিতে হবে। আয়করসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী, করযোগ্য আয় (সাড়ে ৩ লাখ টাকা) রয়েছে-এমন প্রতিটি ব্যক্তির রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে রিটার্ন জমা না দিলে সরকারি-বেসরকারি ৪৩ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে না। বার্ষিক ৪০ লাখ টাকার বেশি আয় থাকলে সম্পদ বিবরণী জমা বাধ্যতামূলক, এর চেয়ে কম আয় থাকলে বিবরণী দিতে হবে না।
এছাড়াও গাড়ি থাকলে বা জমি বা ফ্ল্যাট থাকলে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হবে। কারও স্বামী-স্ত্রী বা নাবালক সন্তানের নামে সম্পদ থাকলে সেটিও সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করতে হবে, যদি তাদের টিআইএন না থাকে। এছাড়া বার্ষিক আয় ৫ লাখ টাকার বেশি থাকলে বা গাড়ি থাকলে বা ব্যবসা হতে আয় থাকলে বা জমি-ফ্ল্যাট থাকলে জীবনযাপনের ব্যয় বিবরণী রিটার্নে উল্লেখ করতে হবে।
আইনে বলা হয়েছে, প্রত্যেক করদাতাকে কর দিবসের মধ্যে রিটার্ন জমা দিতে হবে। তা না হলে মাসিক ৪ শতাংশ হারে বিলম্ব সুদ দিতে হবে। পাশাপাশি সর্বশেষ প্রদেয় করের (আগের বছরের আয়) ওপর ১০ শতাংশ বা এক হাজার টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেই অঙ্কের জরিমানা হবে। এছাড়া কর নির্ধারণ প্রক্রিয়াতেও পরিবর্তন আসবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে-করদাতাকে মোট আয়ের ওপর কর পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে করদাতা আয়কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত হবেন না এবং কর রেয়াতও পাবেন না।
পুরোনো আইনে, করদাতারা উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে রিটার্ন জমার সময় বৃদ্ধির জন্য উপ-কর কমিশনারদের কাছে আবেদন করতে পারতেন। উপ-কর কমিশনার কারণ যৌক্তিক মনে করলে করদাতাকে ২ মাস সময় দিতে পারতেন। এ সময়ের মধ্যেও রিটার্ন দিতে না পারলে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে আরও ২ মাস সময় বৃদ্ধির জন্য যুগ্ম/অতিরিক্ত কর কমিশনারদের কাছে আবেদন করা যেত।
যুগ্ম/অতিরিক্ত কমিশনার চাইলে করদাতাকে রিটার্ন জমার জন্য আরও ২ মাস সময় দিতে পারতেন। অতিরিক্ত সময় নেওয়ার জন্য করদাতার কর গণনা পদ্ধতির পরিবর্তন হতো না। শুধু ২ শতাংশ হারে বিলম্ব সুদ দিতে হতো, জরিমানা হতো না। কর নির্ধারণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হতো। অর্থাৎ করদাতার কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত খাত ও কর রেয়াত (১৫ শতাংশের স্থলে সাড়ে ৭ শতাংশ ধরে) হিসাব-নিকাশ করে কর নির্ধারণ করা হতো। নতুন আইনে জরিমানা ও বিলম্ব সুদ দিয়ে বছরের যে কোনো সময় রিটার্ন জমার সুযোগ রাখা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রফিক সাহেব একজন বেসরকারি চাকরিজীবী এবং তিনি প্রতিবছরই রিটার্ন জমা দেন। তার বার্ষিক আয় ৬ লাখ টাকা। এ অর্থ থেকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা ব্যাংকে ডিপিএস করেন। কর দিবসের মধ্যে রিটার্ন দিলে তার কর গণনার পদ্ধতি হবে এমন-মোট আয়ের এক-তৃতীয়াংশ বা সাড়ে ৪ লাখ টাকার মধ্যে যেটি কম সেই অঙ্ক কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত হিসাবে বিবেচিত হবে। সে হিসাবে রফিক সাহেবের করগণনা করা হবে ৪ লাখ টাকার ওপর। ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমার স্লাব অনুযায়ী, রফিক সাহেবকে ৫ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। তিনি যেহেতু বছরে ৬০ হাজার টাকা ডিপিএসে বিনিয়োগ করেন, সেহেতু আইন অনুযায়ী ৯ হাজার টাকা কর রেয়াতযোগ্য। কিন্তু রফিক সাহেব যেহেতু ন্যূনতম ৫ হাজার টাকা কর দিচ্ছেন, তাই তিনি কর রেয়াত পাবেন না।
এবার দেখা যায়, এক মাস অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর রিটার্ন দিলে রফিক সাহেবের কর গণনার পদ্ধতি কেমন হবে। প্রথমত, দেরিতে রিটার্ন জমা দেওয়ায় তার পুরো আয় করযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হবে। তিনি কর অব্যাহতি প্রায় সীমার (মোট আয়ের এক-তৃতীয়াংশ বা সাড়ে ৪ লাখ টাকা) সুবিধা পাবেন না, এমনকি ডিপিএসের বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও কর রেয়াত পাবেন না। তাহলে কর দিবস পরবর্তী সময়ে রিটার্ন দিলে তার কর গণনার পদ্ধতি হবে এমন-৬ লাখ টাকা আয়ের ওপর তাকে ২০ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে।
যেহেতু তিনি বিলম্বে রিটার্ন দিয়েছেন, তাই করের ওপর ৪ শতাংশ বিলম্ব সুদ অর্থাৎ ৮০০ টাকা বাড়তি কর দিতে হবে। এর সঙ্গে দেরিতে রিটার্ন জমা দেওয়ায় এক হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। সর্বমোট রফিক সাহেবকে এক মাস দেরিতে রিটার্ন জমা দেওয়ায় ২১ হাজার ৮০০ টাকা আয়কর দিতে হবে। হিসাব মতে, এক মাস দেরিতে রিটার্ন দেওয়ায় রফিক সাহেবকে ১৬ হাজার ৮০০ টাকা বেশি কর দিতে হবে। অর্থাৎ প্রায় ৩ গুণ বেশি।
এ বিষয়ে ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুফী মোহাম্মদ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, নীল চাষিদের কাছ থেকে ব্রিটিশরা যেভাবে জোরজবরদস্তি কর আদায় করত, এখন এনবিআরও সেভাবে করদাতাদের কাছ থেকে কর আদায় করতে চাইছে। দেরিতে রিটার্ন জমার জরিমানা আগের নিয়মটিই যথোপযুক্ত ছিল। নতুন আইনে বিলম্ব সুদ বাড়ানো, জরিমানা ও কর নির্ধারণ প্রক্রিয়াতে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেগুলোকে মোটেও করদাতাবান্ধব বলা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, নতুন আইন করলেও সে আইনের অধীনে নতুন রিটার্ন ফরম বানানো হয়নি, আয়কর পরিপত্র প্রকাশিত হয়নি। বাজেট ঘোষণার দুই মাস অতিবাহিত হলেও কেন এসব কাজ করা গেল না। অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ার অবস্থা তো আরও শোচনীয়। এসব গাফিলতির দায় কার? এই গাফিলতির বোঝাও করদাতাদের ওপর চাপানো হবে, যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, সব আইনই প্রয়োগকালে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া যায়। নতুন আয়কর আইনে এ ধরনের কোনো অসঙ্গতি থাকলে অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে।
এ জাতীয় আরো খবর..